তোয়াব খানঃ
দক্ষিণ এশিয়ার চিন্তা-চেতনা এবং মননে সব থেকে প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অগ্রগামী চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছে এমন নয়। বিদেশে, বিশেষ করে শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন এবং আলাপ-আলোচনায় অনুপম দক্ষতা লক্ষ করা যায়। কমনওয়েলথের সদস্য পদ লাভের পর বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৩ সালে এই সম্মেলনে যাওয়ার সময়ও তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনদানকারী বন্ধুদের কথা ভোলেননি। তাই অটোয়া যাওয়ার পথে বেলগ্রেডে প্রেসিডেন্ট টিটোর সাক্ষাতের জন্য যুগোস্লাভ সরকারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। টিটো শুধু যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্টই নন, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি। নেহরু, নাসের, সুকর্ণর সঙ্গে তাঁর নামও সমস্বরে উচ্চারিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের এককালের নেতা স্তালিনের সঙ্গে আদর্শগত বিরোধের পর সামরিক জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের সঙ্গে একযোগে নিরলস ভূমিকা রাখেন। নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রেসিডেন্ট টিটো তথা যুগোস্লাভ সরকারের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বঙ্গবন্ধু নীতিনিষ্ঠার অপরিহার্য অংশ হিসেবে নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর যুগোস্লাভিয়া সফরের কূটনৈতিক সাফল্য এতটাই ছিল যে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যার পর টিটোর সরকার দীর্ঘদিন খুনিদের স্বীকৃতিদান বন্ধ রাখে।
যুগোস্লাভিয়া সফর শেষে বঙ্গবন্ধু গেলেন অটোয়া কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পিয়েরে ট্রুডো, এখনকার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা। ট্রুডো ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। কমনওয়েলথ সংস্থায় বাংলাদেশের সদস্য পদ নিয়ে অনেক গোলমাল করার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু ওটা আর কাজে আসেনি। কারণ কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে।
আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তির সত্যিকার অর্থে একটি সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আমরা মনে করি, দুনিয়াটা দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত। আমরা শোষিতের দলে। এভাবে তিনি ওই সময়ের চলমান বিতর্ক পরিহার করে নিজেদের সম্পদ একত্র করে দেশের উন্নয়ন, তথা গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং ইসরায়েলি জবরদখলের বিরুদ্ধে মিসরের সামরিক অভিযানে বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ সমর্থন আরব নেতাদের মধ্যে বিশেষ করে প্রগতিশীল আরব দেশগুলোয় এক ধরনের সৌভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। তাঁরা চাইছিলেন বাংলাদেশ ইসলামী দেশগুলোর সংস্থা ওআইসিতে যোগদান করুক। ইসলামী দেশগুলোর ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোর শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করুক। ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসির মহাসচিব হাসান আল তাহোমি কয়েকবারই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে দেনদরবার করেন। বাংলাদেশ নীতি হিসেবে জানিয়ে দিয়েছে, যে দেশ এখনো বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি, সেখানে কোনো সম্মেলনে যোগদান বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব। বলা হয়েছিল, সম্ভবত পাকিস্তানের ওকালতিতে, লাহোরের মাটিতে বঙ্গবন্ধু পা রাখা মাত্রই পাকিস্তান স্বীকৃতি দেবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ আবারও সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের কোনো স্থানের মাটি বা আকাশে বাংলাদেশ বিনা স্বীকৃতিতে পা রাখতে রাজি নয়।
১৯৭৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ওআইসি মহাসচিবের কাছ থেকে একটি বার্তা এলো বঙ্গবন্ধুর জন্য। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন তাঁর বিশেষ বিমান পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে লাহোরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিমানে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুতেফলিকার নেতৃত্বে আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি দল রয়েছে। দলে কুয়েতের আমিরের বিশেষ দূত হিসেবে আছেন কুয়েতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান।
ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতিনিধিদল ঢাকা এলো ২২ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধু আলোচনায় জানালেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে লাহোর সম্মেলনে যোগদান সম্ভব নয়। আলাপ-আলোচনার পর প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশের সঙ্গে ঐকমত্যে উপনীত হলো যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একই সময়ে একযোগে পারস্পরিক স্বীকৃতি দেবে এবং লাহোর ও ঢাকা থেকে এ ঘোষণা একসঙ্গে প্রচার করা হবে—এটাও সিদ্ধান্ত হলো। ২৩ ফেব্রুয়ারি ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল লাহোর যাবে।
সন্ধ্যায় গণভবনে মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠক বসে লাহোরে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে। সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত বিশেষ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনুমোদন করা হয়।
লাহোরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই সন্তোষ প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামের স্বীকৃতির জন্য স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমরা এখন আমাদের এই উপমহাদেশ ও বিশ্বে নতুন অধ্যায় সৃষ্টির ভিত্তি রচনায় সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেন ইসলামী বিশ্বের নেতাদের চলমান বিশ্ববাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন বা লাহোরের ইসলামিক সামিটে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তগুলো আজও সমান গুরুত্ব বহন করে।
লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ