করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি দুস্থ ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য তার সহায়তামূলক নির্দেশনাগুলো ছিল সময়োপযোগী। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী প্রশাসন যন্ত্র তথা মাঠ প্রশাসনকে দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন।
গত ২৬ মার্চ লকডাউন শুরু হওয়ায় বেশি বিপদে পড়ে দুস্থ ও স্বল্প আয়ের মানুষ। অর্থনীতির চাকা আচমকা থেমে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ে কম-বেশি সবার ওপর। সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ঘোষণা করেন নানা অর্থনৈতিক প্রণোদনা। গণভবন থেকে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি ধারাবাহিক ভিডিও কনফারেন্স করে নানা দিকনির্দেশনা দেন। আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রশাসন যন্ত্রের সঙ্গে সমন্বয় করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নজরদারি থাকায় সর্বত্র ত্রাণ তৎপরতা স্বচ্ছ ও জবাবদিহি ছিল। কেউ কেউ এদিক-ওদিক করার কিছুটা চেষ্টা করলেও তাদের তাৎক্ষণিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৭২ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়। অনেক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে ‘টার্গেট গ্রুপে’র কাছে সহজইে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে পরিবহন খরচও সরকার বহন করে। ত্রাণ বিতরণকালে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে উপজেলার একজন সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিতরণ ব্যবস্থা সুষ্ঠু থাকায় এখন দেশে ত্রাণ সংকট নেই, হাহাকার নেই। জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) পক্ষ থেকেও ত্রাণের প্রয়োজনীয়তার কথা আর বলা হচ্ছে না বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল দুই-তিন মাসে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে প্রায় সব জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। এসব ভিডিও কনফারেন্সে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় গণ্যমান্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও সংযুক্ত ছিলেন। সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসনকে ১ এপ্রিল ৩১টি, ১৬ এপ্রিল ১০টি, ২০ এপ্রিল ১৩টি এবং ২৭ এপ্রিল ১০টি নির্দেশনা দেন। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তদারকি এবং ৬৪ জেলার ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়ের জন্য ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সচিবদের সঙ্গে সমন্বয় করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব।
এদিকে করোনাভাইরাসের মতো দুর্যোগে মানুষের কষ্ট লাঘবে ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রেখেছে সরকার। এ পর্যন্ত সারা দেশে সোয়া এক কোটির বেশি পরিবারের ছয় কোটির বেশি মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আগামী ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক কোটি দুস্থ মানুষকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ কথা বলা হয়। ভিজিডি, ভিজিএফ, ১০ টাকায় খাদ্য সহায়তা ও অন্যান্য সহায়তাপ্রাপ্ত প্রায় ৭৬ লাখ পরিবার বাদ দিয়ে অবশিষ্ট প্রায় ৫০ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে মোট ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে এ টাকা বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত। নগদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১০ কোটিরও বেশি টাকা। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৭২ কোটি ৫৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ৮১ লাখ ৬২ হাজার এবং উপকারভোগী লোকসংখ্যা ৩ কোটি ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৮৫৮। শিশু খাদ্য সহায়ক হিসেবে বরাদ্দ ২৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ১৮ কোটি ৫৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ৫ লাখ ৯১ হাজার ৮৬৭ এবং লোকসংখ্যা ১২ লাখ ৫৯ হাজার।
ঈদে এক কোটি দুস্থ পাবেন ১০ কেজি করে চাল : কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় দেশের বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়াও দুস্থ, অতিদরিদ্র ব্যক্তি ও পরিবারকে বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেবে সরকার। এ জন্য ১ কোটি ৬ হাজার ৮৬৯টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে ১ লাখ ৬৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়ে গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ কর্মসূচির আওতায় ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলা এবং ‘ক, খ ও গ’ শ্রেণির ৩২৮টি পৌরসভার অতিদরিদ্র ও অসহায় দুস্থ পরিবারপ্রতি ১০ কেজি করে চাল দিতে ৮৭ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পৌরসভার জন্য ১২ লাখ ২৭ হাজার ৬৬৬টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে ১২ হাজার ২৭৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ খাদ্যশস্য ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে ডিসিদের উত্তোলন করতে হবে। বরাদ্দপত্রে বলা হয়, জেলা প্রশাসকরা ভিজিএফ বরাদ্দের বিষয়ে নিজ নিজ এলাকায় সংসদ সদস্যদের অবহিত করবেন। ভিজিএফ উপকারভোগী বাছাইয়ে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক বরাদ্দকৃত ভিজিএফ কার্ড সংখ্যা পুনঃবিভাজন করে তালিকা তৈরি করতে হবে। দুস্থ বা অতিদরিদ্র ব্যক্তি বা পরিবারকে এই খাদ্য সহায়তা দিতে হবে জানিয়ে বরাদ্দপত্রে বলা হয়, সাম্প্রতিক বন্যাক্রান্ত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দুস্থ ও অতিদরিদ্ররা অগ্রাধিকার পাবেন। এক্ষেত্রে সরকার ১২টি শর্ত দিয়েছে। বেঁধে দেওয়া শর্তের মধ্যে চারটি পূরণ করে এমন ব্যক্তি বা পরিবারকে দুস্থ হিসেবে গণ্য করে সহায়তা দিতে হবে। ১২টি শর্ত হলো, যে পরিবারের মালিকানায় কোনো জমি নেই বা ভিটাবাড়ি ছাড়া কোনো জমি নেই। যে পরিবার দিনমজুরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যে পরিবার মহিলা শ্রমিকের আয় বা ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল। যে পরিবারে উপার্জনক্ষম পূর্ণ বয়স্ক কোনো পুরুষ সদস্য নেই। যে পরিবারে স্কুলগামী শিশুকে উপার্জনের জন্য কাজ করতে হয়। যে পরিবারে উপার্জনশীল কোনো ব্যক্তি নেই। যে পরিবারের প্রধান স্বামী পরিত্যক্তা, বিচ্ছিন্ন বা তালাকপ্রাপ্তা মহিলা রয়েছে। যে পরিবারের প্রধান অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা। যে পরিবারের প্রধান অসচ্ছল ও অক্ষম প্রতিবন্ধী। যে পরিবার কোনো ক্ষুদ্রঋণপ্রাপ্ত হয়নি। যে পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে চরম খাদ্য বা অর্থ সংকটে পড়েছে। যে পরিবারের সদস্যরা বছরের অধিকাংশ সময় দুই বেলা খাবার পায় না। জেলা বা উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে বিতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত চাল পৌঁছানোর পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ সরকারি খাত থেকে বহন করতে হবে। ভিজিএফ উপকারভোগীর তালিকা এমনভাবে করতে হবে যেন একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি বরাদ্দ না পায়।