বিশেষ নিবন্ধ : জুলাই ৯ তারিখটি দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে এখন আর আলাদা করে কোন তাৎপর্য বহন করে না। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার যে সুদূরপসারী চক্রান্ত, সেই ইতিহাসের একটি অন্যতম কালো তারিখ এই দিনটি। এই দিনেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনিটি অনুমোদিত হয় জাতীয় সংসদে আর এর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি পরিণত হয় আইনে । ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ইসডেমনিটি অধ্যাদেশটি জারি করেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দায়মুক্তি দেয়ার অশুভ উদ্দেশ্যে। এটি ছিল ১৯৭৫-এর ৫০ নম্বর অধ্যাদেশ, তবে এটি আইনে পরিণত হয় জেনারেল জিয়ার সময়ে গঠিত জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনিটির মাধ্যমে।
১৯৭৬-এর ২৯ এপ্রিল জেনারেল জিয়া তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। পরবর্তীতে বন্দুকের নলের মুখে বিচারপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে ১৯৭৭ সালে প্রহসনমূলক একটি ‘হ্যা-না’ ভোটের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। আর ৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭৯-এর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক আইনের অধীনে যত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল সে সবগুলোকে ৭৯-এর জাতীয় সংসদ পঞ্চম সংশোধনীটির মাধ্যমে বৈধতা প্রদান করে যার ফলে রুদ্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের পথও। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি রিপিল বিল পাস করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।
দুই.
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটির উদ্দেশ্য শুধু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার রুদ্ধ করাই ছিল না, এর উদ্দেশ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। এর মূল লক্ষ্য ছিল দেশে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি করা, প্রতিষ্ঠা করা কালচার অফ ইম্পিউনিটি। বাংলাদেশ আজও সেই জায়গাটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যদিও এর জন্য চেষ্টা কম কিছু করা হয় নি। কেউ যদি ইনডেমনিটির রিপিল বিল পাস করাকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকরীদের বিচারের পথ সুগম করা বা যুদ্ধাপরাধীদের আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের আওতায় আনাটাকে শুধু ৭১-এ এ দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ বলে মনে করেন, তাহলে মোটাদাগে তিনি হয়তো ঠিকই বলছেন, কিন্তু এসবের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা আর অপরাধীকে বুঝিয়ে দেয়া যে অপরাধী সে যেই হোক না কেন সে অবশ্যই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
তিন.
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আবারো সঠিক পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। কখনো কখনো দৌড়াচ্ছেও বাংলাদেশ। এই যেমন অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিংবা জীবনমান উন্নয়নের মাপকাঠিতে অথবা এই চলমান অতিমারির সময়ও কোভিডকে সামলে রাখার ক্ষেত্রে। সমস্যা হচ্ছে আমাদের এতসব বড় বড় সাফল্যগুলো কোথায় যেন মাঝে-সাজেই বড় ধরনের প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়ে পরে। আমরা হয়তো মাত্রই প্রশস্তির বড় একটা ঢেঁকুর তুললাম যে আমরা তো এগিয়ে গেছি অনেকটাই, তখনই কোত্থেকে কিভাবে যেন কি একটা ঘটে যায় আর আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জায়গাটায় এখনও অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে।
চার.
একটু কৈফিয়ত দিয়ে নেই। কোন ব্যক্তি বা কোন পেশার চরিত্র হনন আমার উদেশ্য নয়। পেশাজীবী আর প্রশাসনের মধ্যে মাঝে-মধ্যেই যে অস্বস্তি, সেটিও আমার নেহাতই অপছন্দের। পাশাপাশি আমি অবশ্যই মিডিয়া ট্রায়ালের বিরুদ্ধে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে শুধু মিডিয়ার রিপোর্টের ভিত্তিতে কাউকে দোষী বলার চেয়ে বড় অন্যায় আর কোন কিছুই হতে পারে না।
পাঁচ.
কদিন ধরেই মিডিয়ায় দেখছিলাম প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো কোন কোন জায়গায় ধ্বসে পড়ার খবরগুলো। মিডিয়াই জানাচ্ছে পাঁচজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে আর তদন্তাধীন আছেন আরো শতাধিক কর্মকর্তা। আমি তাদের কাউকেই দোষি সাব্যস্ত করছি না, যতক্ষণ না তারা দেশের প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী দোষি সাব্যস্ত হচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কায়কাউস মিডিয়ায় বলেছেন, এই প্রকল্পটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবাদতের মত। কাজেই এ বিষয়ে সরকার জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করবেন।
আমি মাননীয় মুখ্য সচিব মহোদয়ের সাথে একেবারেই সহমত। তবে আমার শংকার জায়গাটা অন্যখানে। এই শতাধিক কর্মকর্তার সবাই না হলেও কেউ কেউ তো নিশ্চই একটা সময় দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। এরাতো প্রশাসনের সেই টগবগে তরুণ তুর্র্কী, এই মধ্যবয়সে এসে যাদের দিকে তাকিয়ে আমরা ২০৪১-এ উন্নত বাংলাদেশের দক্ষ ম্যানেজারদের খুঁজে পেতে চাই। তাদেরই কারো কারো অবক্ষয়টা আজ যদি এই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে থাকে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবাদতেও ভাগ বসাতে তাদের আর বাধছে না, তাহলে তো বলতেই হবে জিয়াই সফল, সফল মোশতাক এন্ড গং আর ব্যর্থ আমরা।
ছয়.
একটা সময় মনে করা হতো যে বাংলাদেশে আর যাই হোক না কেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করাটা অসম্ভব। এই খুনি ফারুক-রশীদকেই গুলশান এভিনিউ আর ময়মনসিংহের চরপাড়া মোড় আমি দাপিয়ে বেরাতে দেখেছি প্রকাশ্যে মার্সিডিজ জিপ হাকিয়ে। ৯৬-এর নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদরের নৌকার প্রার্থী প্রয়াত রতনদার নির্বাচনী প্রচারে যে ফ্রিডম পার্টির কর্মীদের কুড়ালের ধাওয়া খেয়ে দিনে দুপুরে দৌড়ে পালানোর স্মৃতি আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল। সেই প্রবল প্রতাপশালী ফারুক-রশীদরা আজ বাংলাদেশে পাস্ট টেন্স।
আজ আমাদের কারো কারো যে দুর্নীতি আর নৈতিক অবক্ষয় বাংলাদেশের প্রতিপক্ষদের হৃদয়ে আশার নাচন তোলে ঢাকায়, পাকিস্তানে কিংবা লন্ডনে তারাও জেনে রাখতে পারেন যে এই আর্বজনাগুলোও বাংলাদেশে শেষমেষ শিকড় গাড়তে পারবে না। ভেসে যাবে ঠিক ঠিকই কচুরিপানার মতই। কচুরিপানার মতই এরা হয়তো সংখ্যায় এখন দেখাচ্ছে অনেক, কিন্তু এদের শিকড়ের দৌড় কচুরিপানার মতই কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।