ডা. নুজহাত চৌধুরী : জনস্বাস্থ্যবিদরা শুরুতেই জানিয়েছিলেন আমাদের করোনা অতিমারির এই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার বিষয়টি। ছোঁয়াচে রোগ একজন থেকে আরেকজনের হয়। তাই জনসংযোগ কমিয়ে দিতে পারলে এর সংক্রমণ কমে যাবে। তারপর যখনই আপনি চেষ্টা করবেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে, তখনই ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাবে। তখন আবারও কিছুদিন কঠিন কিছু ব্যবস্থার মাধ্যমে তাকে আয়ত্তে নিয়ে আসা হবে। এভাবে একসময় ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যাবে অথবা প্রতিষেধক চলে আসবে এবং আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাব। এটাই মহামারি অথবা অতিমারির ঘটনাচক্র।
কিন্তু বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে একবুক পরিতাপ নিয়ে। সব হতাশাবাদীর কঠিন ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ করোনার প্রথম ঢেউ খুব ভালোভাবে মোকাবেলা করেছিল। শুধু তা-ই নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রথম বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের আগে টিকা জোগাড় করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে টিকা দেওয়া শুরু করে ঘরে-বাইরে প্রশংসিত হয়।
তার পরই ঘটে বিপত্তি। আমাদের ভেতর একটা বেপরোয়া ভাব চলে আসে। তিন দিনের এক অবকাশে লাখ চারের বেশি লোক সমবেত হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। সেই সঙ্গে চলতে লাগল ঘটা করে বিয়েশাদি, ঘোরাঘুরি, সামাজিক সব আয়োজন। এক ডোজ টিকা দিয়েই সবাই ভাবতে শুরু করলেন, তাঁরা করোনার বিরুদ্ধে নিশ্চিত নিরাপত্তার গ্যারান্টি পেয়ে গেছেন। শুরুতেই সবাই যে ভয়টি পেয়েছিলেন সেটা সম্পূর্ণ কেটে গিয়ে আমরা একেবারে বন্ধনহীন বেপরোয়া হয়ে পড়ি।
টিকা নিলেও তা যে আপনাকে শতভাগ প্রতিরোধ দেয় না, বিজ্ঞানীরা বারবার এ কথা বলেছেন। টিকার লাভ এটাই যে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর আপনার আবার সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা কমে আসার পাশাপাশি করোনার সংক্রমণে আপনার আইসিইউয়ে ভর্তি হওয়ার বা মৃত্যুবরণ করার আশঙ্কাও অনেকটা কমে আসে। বেঁচে থাকার জন্য সেইটুকু সম্ভাবনার কি বিশাল এক প্রাপ্তি নয়? কিন্তু সেই সুবিধাটা পাওয়া যাবে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কিছুদিন পর। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে দ্বিতীয় ডোজ নিলেও সংক্রমিত হলে আপনি অন্যের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে বেড়াতে পারেন নিজের অজান্তেই। বিজ্ঞানীরা, চিকিৎসকরা এ কথাগুলো বলে চলেছেন অবিরত।
কিন্তু তাতে কী? আমরা কি ডরাই সখী করোনাকে? এক ডোজ নিয়েই চললাম কক্সবাজার। বিয়েশাদি অয়োজন করলাম জমজমাট। বড় করে বিয়ে না দিলে তো প্রেস্টিজ পাংচার। তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের কথাও তো একটু ভাবতে হবে আমাদের, তাই না? আমরা শপিং না করলে তারা খাবে কী? ধর্ম-কর্মেও শতেক বাধা। গত বছরও জামাতে তারাবি পড়তে দিল না, ঈদের নামাজটা পর্যন্ত পড়তে হলো বাসায়। কাঁহাতক আমাদের ধর্মপ্রাণ নরম হৃদয়ে এ বেদনা সহ্য হয়? আমার পরিচিত মধ্যম সারির এক স্বাস্থ্যকর্মী সেদিন আমাকে তাঁর সুচিন্তিত মতামত জানালেন যে এই সব হচ্ছে সরকারের ষড়যন্ত্র। গম্ভীর গলায় আমাকে জানালেন, হেফাজতের তীব্র আন্দোলন বন্ধের জন্যই নাকি সরকার লকডাউন দিয়েছে। জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যই নাকি স্কুল বন্ধ রেখেছে। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত, মোটামুটি শিক্ষিত একটি মানুষেরই যদি ধারণা এই হয়, তাহলে অশিক্ষিত মানুষদের আর কী দোষ?
ইদানীং হতভম্ব হয়ে মানুষের ঈদ শপিংয়ের ছবি দেখছি অনলাইনে। ফেসবুকে স্ক্রল করলে একদিকে দেখছি দিল্লির শ্মশানঘাটের সারি সারি চিতার আগুন, তার নিচের পোস্টেই দেখছি এ দেশের বিভিন্ন মার্কেটের মাস্কবিহীন ক্রেতাদের ঈদের কেনাকাটার ধুম। কিভাবে সম্ভব? কী ভাবছে তারা? করোনাভাইরাস সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যাবে? ভারত আর বাংলাদেশের আকাশ, বাতাস, নদী, সমুদ্র, মাটি আর মানুষ—কোনটায় কতটা দূরত্ব? আমাদের জেনেটিক গঠনও তো এক। ওই দেশে মিউটেশন হয়েছে ভাইরাসের আর আমাদের এখানে হয়নি? না হয়ে থাকলে কি হবে না? তাও যদি না হয়, ভারত থেকে এ দেশে ভাইরাসের আসতে কতক্ষণ? কেন শপিংয়ে যেতেই হবে? শুনেছি ন্যাড়া বেলতলায় বারবার যায় না। আমাদের কী হলো যে আমরা স্বেচ্ছায় বারবার সংক্রমণের পথে হাঁটছি?
মুভমেন্ট পাসের জন্য দ্বিতীয় দিনে সাত কোটি ৮১ লাখ লোক পাস পাওয়ার জন্য ওয়েব পেজে লগইন করেছেন বলে একটি খবর পড়লাম। ১৭ কোটি মানুষের দেশে এক দিনেই প্রায় আট কোটি মানুষের এত কি জরুরি প্রয়োজন পড়ল যে প্রাণের ভয়কে উপেক্ষা করতে হবে? আট কোটি যদি দৈনিক বেরিয়ে পড়ে, তো আর লকডাউন দেওয়ার লাভ কী? আবার দোকান খোলা রেখে লকডাউন দেওয়ার মানেটাই তো আমি বুঝিনি। শপিংয়ের জন্য মুভমেন্ট পাস নেব? কেন? নতুন জামা না পরলে কি ঈদ হবে না? নাকি নতুন জামা পরে ঈদের দিন হাসপাতালে যাওয়ার পাস এগুলো?
আপনাদের কেনাকাটায় বাধা দিচ্ছি না। কেনাকাটা তো অনলাইনেও করা যায়। আমরা ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করছি না, তাও নয়। বড় ব্যবসায়ীদের কথা বলছি না, তাদের নিয়ে চিন্তা নেই। তাঁরা তাঁদের স্বার্থ খুব ভালোই সংরক্ষণ করতে পারেন, তা তো গত বছরই দেখেছি। বড় ব্যবসায়ীরা করোনার অতিমারির শুরুতেই কোটি কোটি টাকা নিজেদের জন্য প্রণোদনা নিয়েছেন। তার কতটা তাঁদের শ্রমিকদের সহায়তায় ব্যবহৃত হয়েছে আমার সন্দেহ আছে। তবে অভাবে তাঁদের কারো যে পাজেরো গাড়ি বিক্রি করতে হয়নি তা কিন্তু নিশ্চিত। বলছি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা। তাদের জন্য সরকার প্রণোদনার উদ্যোগ নিলে তা যথার্থ হবে। দিন আনে দিন খায় যারা, তাদের সহায়তায় কিভাবে সমাজ ও সরকার এগিয়ে আসবে সে ব্যবস্থাও দ্রুত নেওয়া প্রয়োজন। সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়েন মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ। হাত পাততেও পারেন না, আয় কমে গেলে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যায়। এ বিষয়গুলো মানবিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে নিশ্চয়। সে জন্য সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেই সমাধান জনস্বাস্থ্য পরিপন্থী হওয়া চলবে না, বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে। কারো স্বার্থেই মানুষের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। দোকানপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী, এটা অতি শিগগির রহিত করে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ঈদের আনন্দে কমনসেন্স ভেসে যাওয়ার আগেই থামিয়ে দেওয়া দরকার। না হলে জানটাই ভেসে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি।
মানুষ থেকে মানুষের সংক্রমণে আমি-আপনি-আমরাই যোগসূত্র, আমরাই মাধ্যম, আমরাই চেইন। সংক্রমণের দ্বিতীয় এ ঢেউ বন্ধ করতে হলে এই চেইন ভাঙতে হবে। মানুষের মধ্যে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে হবে। একের পর এক ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার এই চেইনের যে স্থানে আমরা আছি, সেখানে আমরা উপস্থিত না থাকলে চেইনটা ভেঙে যাবে। আমরা বাঁচব, বাঁচবে চেইনের ধারাবাহিকতায় আমার দ্বারা সংক্রমিত পরবর্তী সবাই। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কমে আসবে। জনসমাগম না করলে, মাস্ক পরলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যাবে তা না। কিন্তু আক্রমণের শিকার কমবে, কম মানুষ অসুস্থ হলে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কম পড়বে, মৃত্যু কমবে। আসুন, চেইনটা ভেঙে দিই। আমার পরে আমার কারণে শত শত মানুষের মৃত্যু আমি ঠেকিয়ে দিই। চলুন, ঘরে থেকে আমরা সবার বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরি করে দিই।
লেখক: অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।