ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : ১৭ এপ্রিল একাত্তরে মেহেরপুরের মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। রাষ্ট্রপ্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাথে প্রধানমন্ত্রী তাজউদদীন আহমদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা। বঙ্গবন্ধু শরীরী অনুপুস্থিতিতে একটি বৈধ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল স্বাধীনতার পথে আমাদের দুই যুগের যাত্রার সশস্র পর্বটি। এর আগে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রকাশ করা হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র। আর এই ঘোষণাপত্রটির ভিত্তিতেই শপথ নিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারটি।
স্বাধীন বাংলাদেশের পথ চলায় ১০ আর ১৭ এপ্রিল তাই অসম্ভব গুরুত্ববহ দুটি তারিখ। এই এপ্রিলেই আছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন- ১৪ এপ্রিল, বাঙালির নববর্ষের প্রথম দিনটি।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির বাঙালিয়ানা উৎযাপনের দিন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের অসারতা আর জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যৌক্তিকতা উদযাপনের দিন এই পহেলা বৈশাখ।
অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে আজ আবারো কঠিন সময়ের মুখোমুখি বাংলাদেশ। আজ থেকে পঞ্চাশটি বছর আগে একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল পহেলা বৈশাখ, এবারেও তাই। এবারে অবশ্য আমরা ডিজিটালি উদযাপন করেছি বৈশাখের এই প্রথম দিনটিকে। কিন্তু বৈশাখকে কি ছোঁয়া যায় ডিজিটালি?
আমাদের এবারের চ্যালেঞ্জটার ধরনটা ভিন্ন। এবারে যেমন প্রতিপক্ষ অদৃশ্য তেমনি দৃশ্যমানও বটে। এবারের অবশ্য আমাদের একাধিক স্বস্তির জায়গাও আছে। প্রথমত এবারের সংকটটি বিশ্বজনীন। আর এবারও আমরা আমাদের পাশে পেয়েছি একাত্তরে আমাদের বিশ্বস্ত সহযাত্রীদের। উপরি হিসেবে আছেন আরো কেউ কেউ, একাত্তরে যাদের অবস্থান ছিল টেবিলের অন্য প্রান্তে। তবে এবারের যুদ্ধে আমাদের সবচাইতে বড় স্বস্তির জায়গাটি হলো গতবারের যুদ্ধটি যেমন পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, এবারেও নেতৃত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার ধমনীতে জাতির পিতার রক্ত প্রবহমান। মুজিবনগর সরকারের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল অভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাত খোন্দকার মোশতাকের মত বিশ্বাসঘাতক যেমন একদিকে ছিল মুজিবনগরের মন্ত্রিসভায়, তেমনি ছিল নীতিভ্রষ্ট বাম আর সুশীল নামধারী কিছু মানুষ যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার-আল বদর-আল শামস আর মুজাহিদ বাহিনীর সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও এদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। ১৯৭৩-এর বিজয় দিবসকে নষ্ট বামরা ঘোষণা করেছিল কালো দিবস হিসেবে আর ৭৪-এর ১৫-১৬ ডিসেম্বর ডাকা হয়েছিল হরতাল, উপড়ে ফেলা হয়েছিল রেললাইন, ঠিক আজকের হেফাজতিদের মত।
এ সব বাস্তবতাকে মোকাবেলা করেই স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরে শাসনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ৭৫-এ তা পরিণত হয়েছিল ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেশে। সেদিন যখন বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন আজ কোভিড-১৯ মোকবেলায় বঙ্গবন্ধু কন্যা ঠিক ঠিক উতড়ে যাবেন তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় আজ হয়তো কিছুটা টাল-মাতাল আমরা, কিন্তু গত বছর কোভিডের প্রথম ঢেউটির মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের এবারো আস্থাশীল হওয়ার স্বপক্ষে যুক্তি অজস্র।
এবারো ঢাকার রাজপথে ফুটবে ফুল, কক্সবাজার উপকূলে সাঁতার কাটবে ডলফিন, হাসবে মানুষ আর হারবে কোভিড। পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট আপডেট আর আমাদের কোভিড-১৯ ইর্মাজেন্সি রেসপন্স এন্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম আশা জাগাচ্ছে কোভিডের অনাগত তৃতীয় বা চতুর্থ ঢেউয়ের মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা থাকবে অনেক বেশি।
পাশাপাশি উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধটিতেও এখন ব্যাকফুটে ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠি। হেফাজত যে নতুন বোতলে জামায়াত নামক পুরাতন সুরা, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তা বুঝতেও কারো আর বাকি থাকার কথা নয়। কোভিডের পরবর্তী ধাক্কাগুলো আরো ভালোভাবে জেতায় আমাদের এখন থেকেই যেমন সাজ সাজ প্রস্তুতি, দৃশ্যমান পুরাতন শত্রুর বিরুদ্ধেও দীর্ঘ মেয়াদে একই ধরনের উদ্যোগ বাঞ্ছনীয়। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা এখন যেমন জরুরি, জরুরি তেমনি দেশদ্রোহিতার অপরাধে হেফাজত আর তার নেতাদেরও বিচারের মুখোমুখি করা। পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করে আমাদের কোমলমতি শিশুদের কোরবানির পশু জবাই করার কারিগর হিসেবে তৈরি না করে দেশ গড়ার কারিগরে রূপান্তরিত করাটাও খুব বেশি প্রয়োজন।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে দৃশ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধটা ছিল অনিবার্য, ঠিক যেমনটি অনিবার্য অদৃশ্য কোভিডের বিরুদ্ধে আমাদের আজকের যুদ্ধটা। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও যে আমাদের মৌলবাদ আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ঝুঝতে হচ্ছে সেটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরের ১৭ এপ্রিলের বাস্তবতা যেন আজকের মত না হয় তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে এখনই। কারণ আমাদের পূর্বসূরিরা উতড়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আর আমরা উতড়ে যাচ্ছি বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে, কিন্তু আমাদের উত্তরসূরিরা এতটা সৌভাগ্যবান নাও হতে পারেন !
লেখক : চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।