‘শেখ রাসেল’ নির্মমতার বলি সম্ভাবনাময়ী এক নিষ্পাপ প্রাণ – নজরুল ইসলাম

প্রচ্ছদ

১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাস। স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনে উত্তপ্ত পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর এনডিএফ কার্যকারিতা হারালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ কে পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারী ঘোষিত হয় পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন। পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী করা হয় মিস ফাতেমা জিন্নাহ কে। নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা এবং মিছিল, সমাবেশে তখন সরগরম পুরো দেশ। এমনি এক সময়ে ১৭ অক্টোবর দিবাগত রাত দেড় টার দিকে অর্থাৎ ১৮ ই অক্টোবরের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িতে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কোল আলোকিত করে জন্ম হয় ফুটফুটে এক শিশুর। সে সময় পিতা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ফাতেমা জিন্নাহ’র নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন চট্টগ্রামে। পিতা মুজিব এবং মাতা বেগম মুজিব তাদের প্রিয় লেখক, দার্শনিক এবং নোবেল বিজয়ী, যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’ এর নামানুসারে শিশুটির নাম রাখেন ‘শেখ রাসেল’।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ রাসেলের বড় বোন শেখ হাসিনা শেখ রাসেলের জন্মের সেই আনন্দঘন রাতের স্মৃতিচারণ করেছেন তার লেখায়। সেই দিনটির কথা মনে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, “১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিল রাত দেড়টায়। রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো, ফুফু বললেন তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল।’

শিশু রাসেলের যেদিন এই পৃথিবীতে আগমণ ঘটেছিল, বার্ট্রান্ড রাসেল তার আগেই ৯২ বছর অতিক্রম করে ৯৩ – এ পা রেখেছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে বঙ্গবন্ধু যেসব কারণে তার সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর নাম রাসেল রেখেছিলেন, তার একটি কারণ বার্ট্রান্ড রাসেলের মত তার শিশু পুত্রের দীর্ঘ জীবন প্রাপ্তির আকাঙ্খা বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল কি না তা অজানাই রয়ে গেছে। তবে তার শিশু পুত্র বার্ট্রান্ড রাসেলের মত একদিন পৃথিবী বিখ্যাত হবে এমন আকাঙ্খা থেকে হয়ত তার নাম ‘রাসেল’ রাখা হয়েছিল বলে সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার সেই আকাঙ্খার অপমৃত্যু ঘটেছিল ঘাতকের উদ্ধত বন্দুকের নির্মম সঙ্গিনে ১১ বছরে পা রাখার আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু ছোট্ট রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি।” ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।” বঙ্গবন্ধু তখন অনেক বড় নেতা, বাঙালির আশা-আকাঙ্খার প্রতীকে পরিণত হতে চলেছেন। অথচ নিজের দুই বছরের ছোট্ট ছেলেটার কাছে বড় অসহায়! শিশু রাসেলের জন্য পিতা মুজিবের এই করুণ আর্তি আমাদের অশ্রুসিক্ত করে এখনো।

শেখ রাসেল ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, মিস্টি চেহারার এক হাস্যজ্জ্বল দূরন্ত বালক। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। শেখ রাসেল কেবল একজন রাষ্ট্র প্রধানের সন্তান ছিলেন না, ছিলেন রাষ্ট্রের স্থপতির সন্তান। তবে তার চলাফেরা আর দশজন রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধানের ছেলেদের মত ছিল না। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির আঙিনা আর পাশের রাস্তার নির্দিষ্ট সীমানায় সাইকেল চালিয়ে বেড়াতেন শাঁ শাঁ করে। পাশের লেকের পাড়ে চক্কর মারতেন মাঝেমধ্যে। ছিল না কোনো প্রটোকল। দূরন্ত রাসেল সাইকেল চালাতেন আর ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বীগ্ন মা বেগম মুজিব তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন পরম মমতা আর উৎকণ্ঠায়।

সাধারণ মানুষের প্রতি শিশু রাসেলের প্রগাঢ় মমত্ববোধ এবং ভালবাসা ছিল। ৮-১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল ছিলেন ভীষণ ন্যায়পরায়ণ। শেখ রাসেল কে নিয়ে তার তিন বছরের (১৯৭২- ‘৭৫) গৃহ শিক্ষিকা গীতালি চক্রবর্ত্তীর একটি স্মৃতিচারণে রাসেল চরিত্রের এসব দিক স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। শিক্ষিকা গীতালি চক্রবর্ত্তী রাসেল সম্পর্কে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন-
তখন শীতের দিন। ৩২ নম্বরের পাশের বাড়িতে রাসেল নামে আরেকটি শিশু ছিল। শেখ রাসেল প্রায় সময় তার সঙ্গে খেলতো। একদিন এক বুড়ি ঐ বাড়িতে ভিক্ষা করতে আসলে ভিক্ষা না দিয়ে একটি কাজ করে দেওয়ার শর্তে তাকে এক টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। বুড়িটি শর্তে রাজি হয়ে কাজ করে দেওয়ার পর তাকে এক টাকার পরিবর্তে মাত্র পঁচিশ পয়সা দিলে মন খারাপ করে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসেন। রাসেল বুড়িমাকে ডেকে এনে গেটের সামনে বসিয়ে রাখেন। উদ্দেশ্য পিতা বঙ্গবন্ধু বাড়িতে আসলে তার কাছে বিচার দেওয়া। দুপুরে তাকে খাবারও দেওয়া হয়। শীতে তো বুড়ি মা’র জবুথবু অবস্থা। কিন্তু পিতা বঙ্গবন্ধু না আসলে রাসেল বুড়ি মা-কে যেতে দিতে নারাজ। অবশেষে বুড়ি মা-কে রাতের খাবার এবং আরও বেশি টাকা দেওয়ার শর্তে তাকে যেতে দিতে রাজি হয় শেখ রাসেল।

আট-দশ বছরের যে শিশুটি এতটা মমত্বময়, ন্যায়পরায়ণ এবং মানবতাবাদী ছিলেন তিনি বড় হলে কেমন হতেন তা সহজেই অনুমেয়। এ কারণেই বাঙালি জাতির পিতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করার সময় এগার বছরের সম্ভাবনাময়ী নিষ্পাপ শিশু রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল নৃশংস খুনীর দল। খুনীরা জানত, তাকে বাঁচিয়ে রাখলে সেই একদিন পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কেউ যাতে কোনোদিন এদেশের নেতৃত্বে আসীন হতে না পারেন, এই লক্ষ্যে সেদিন শিশু পুত্র, অন্তঃসত্ত্বা মা এবং নববিবাহিতা পুত্রবধূকে ও হত্যা করা হয়েছিল। তবে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আজ বঙ্গবন্ধুর রক্তের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে সফলভাবে টানা প্রায় পনেরো বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে তলাবিহীন ঝুড়ির শূন্য বাংলাদেশ আজ উন্নত, আধুনিক আর ডিজিটালাইজেশনের সিঁড়ি পেরিয়ে সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশে রুপান্তরের শেষ ধাপে। পিতার স্বাধীন করা শূন্য বাংলাদেশে সাইকেল চালানো এগারো বছরের শেখ রাসেল আজ বেঁচে থাকলে হতেন ঊনষাট বছরের এক পরিপূর্ণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরসূরী হিসেবে তিনি আজ হয়ত এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতেন, নয় তো বোনের পাশে থেকে তাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহায্য করতেন বোন শেখ রেহানার মত! ১৮ ই অক্টোবর শেখ রাসেলের ৬০ তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।


লেখকঃ মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *