সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখানে (সংসদে) প্রশ্ন উঠেছে, ওই সংসদ সদস্য (পাপুল) নাকি কুয়েতের নাগরিক! সে কুয়েতের নাগরিক কি-না, সেটা নিয়ে কিন্তু কুয়েতের সঙ্গে কথা বলছি, বিষয়টা দেখব। যদি এটা হয়, তাহলে তার ওই আসনটি (লক্ষ্মীপুর-২) খালি করে দিতে হবে। যেটা আইন আছে, সেটাই হবে। আর তার বিরুদ্ধে এখানেও তদন্ত চলছে।
গতকাল জাতীয় সংসদে মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হওয়া লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম পাপুল সম্পর্কে তিনি সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
এর আগে বিএনপির এমপি মো. হারুনুর রশীদ পয়েন্ট অব অর্ডারে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপির বিষয়ে স্পিকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। অনেক দিন পর পয়েন্ট অব অর্ডারে বিরোধী দলের কোনো বক্তব্যের জবাব দিলেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
কুয়েতে গ্রেফতার সংসদ সদস্য পাপুলের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, যে সংসদ সদস্যের কথা বলা হয়েছে, সে কিন্তু স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য। সে কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আমাদের (আওয়ামী লীগের) নমিনেশন চেয়েছিল, আমি কিন্তু দেইনি। সে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছে। গত নির্বাচন ওই আসনটি জাতীয় পার্টিকে দিয়েছিলাম। জাতীয় পার্টির নোমান (প্রার্থী) নমিনেশন পেয়েছিল। কিন্তু সে নির্বাচন করেনি। এ কারণে ওই লোক (এমপি পাপুল) জিতে আসে। এরপর আবার তাঁর স্ত্রীকেও যেভাবে হোক বানায় (সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য)। কাজেই তাকে এমপি হওয়া কিন্তু আমাদের বানানো নয়।
রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতাল নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা বলেন, ওই (রিজেন্ট) হাসপাতালের এই তথ্য কিন্তু আগে কেউ দেয়নি, জানাতে পারেনি। অন্য কেউ জানায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেই খুঁজে বের করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। র্যাব সেখানে গেছে। সেখান থেকে জড়িতদের খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটা কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেই ধরেছি। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এবং অনিয়মগুলো খুঁজে বের করেছি। ইতিমধ্যে জড়িতদের গ্রেফতারও করা হয়েছে।
করোনাকালে ত্রাণ সহায়তার দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে ৫০ লাখ পরিবারকে আমরা সহায়তা দিচ্ছি। তাদের তালিকা বানানো হয়েছে। সেই তালিকা তিন দফা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের আইডি কার্ড ভোটার লিস্টে নাম সবকিছু মিলিয়ে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। সবকিছু যাচাই করে সঠিক ব্যক্তির কাছে টাকাটা পৌঁছে দিচ্ছি। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের সময়ও লেগেছে। অন্য যে নামধাম (ভুয়া/অযোগ্য) এসেছে, তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
মানব পাচারে কারা জড়িত দেখা দরকার : জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানব পাচারের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সোনার হরিণের স্বপ্ন দেখিয়ে কারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা ভালোভাবে দেখা দরকার। আমি মনে করি সংসদ সদস্য একটা সঠিক কথাই বলেছেন, এটা ভালোভাবে দেখা দরকার। এ সময় সংসদকে তিনি জানান, যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সরকার তদন্ত করে সেইসব রিক্রুটিং এজেন্সিকে ধরছে, যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তিনি দেশের মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিবন্ধিত কর্মীরা যখন বৈধভাবে বিদেশে যায়, তখন তাদের চাকরির নিরাপত্তা, বেতনের নিরাপত্তা সবই থাকে। দুর্ভাগ্য, তারপরও মানুষ এই ধরনের এজেন্টদের খপ্পরে পড়ে, দালালদের খপ্পরে পড়ে। তারপরে তারা লাখ লাখ টাকা দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। ওরা নিয়ে গিয়ে কিন্তু আবার তাদেরকে জিম্মি করে, ওদের টর্চার করে, মারে, রেকর্ড শোনায়, আবার টাকা দাবি করে। তাদের আবার এজেন্ট থাকে, তারা টাকা নেয়। দেশবাসীকে এদের ব্যাপারে সচেতন থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয় : সরকারদলীয় সদস্য আবদুল লতিফের (চট্টগ্রাম-১১) প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনার প্রভাবে সারাবিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে এর প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যে অনেক প্রতিরোধ/প্রতিকারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। দ্রুততম সময়ে সঠিক কৌশল অনুসরণ করায় এ পর্যন্ত দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারী বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে এক অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন করেছে। উন্নত দেশগুলো এ ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস মোকাবিলায় কোনো কার্যকর টিকা বা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এ রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং বিস্তার রোধে মাস্ক ব্যবহার, কাশি শিষ্টাচার, শারীরিক দূরত্ব, হোম কোয়ারেন্টাইন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন মেনে চলা ও সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই মূল কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল অংশ দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল : আবদুল লতিফের লকডাউন সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনা বিস্তাররোধে লকডাউন কার্যকর কৌশল হলেও এই পরিস্থিতি দীর্ঘকাল থাকলে কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এতে কর্মহীনতা ও দরিদ্রতা লাগামহীন হারে বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে কর্মহীনতা ও দরিদ্রতা লাগামহীন হারে বেড়ে অন্যান্য কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সমন্বিত জনস্বাস্থ্য প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।
করোনার কারণে ১৪ হাজার ৯৫৭ জন প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছে : সরকারি দলের সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে (১২ জুন পর্যন্ত) ১৪ হাজার ৯৫৭ জন প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এসেছে।
বিদেশে কর্মহীন হয়ে পড়া কর্মীদের পুনঃনিয়োগে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে : সরকারি দলের বেনজীর আহমদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হয়ে পড়া বাংলাদেশি কর্মীরা যাতে করোনা পরবর্তী সময়ে পুনরায় কর্মে নিয়োগ পেতে পারে সেজন্য বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া এই অন্তর্বর্তী সময়ে বিদেশের বাংলাদেশ
মিশনের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের মাধ্যমে আমরা দুস্থ ও কর্মহীন প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে প্রায় ১১ কোটি টাকার ওষুধ, ত্রাণ ও জরুরি সামগ্রী বিতরণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদেশফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুকূলে পাঁচশ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করেছি। আমরা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে দুইশ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছি। এ সংক্রান্ত নীতিমালা ইতিমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে।
‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা’ প্রকাশ হবে : জাতীয় পার্টির এমপি মুজিবুল হন চুন্নুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা’ একটা লেখা আছে। এটি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র মতোই উনার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে কিছু লেখা। আমার ধারণা, এটা ছিল একটি রাফ কাজ। প্রথমে তিনি ওটা করেন। তারপর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রস্তুত করেন ছাপানোর জন্য। সেই লেখাগুলো আমি প্রস্তুত করেছি। তা প্রায় তৈরি হয়ে আছে। ওটা আমরা ছাপতে দেব। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র মতো ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা’ নামে আরেকটি বই প্রকাশ করা হবে। এ সময় তিনি সংসদে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’সহ বঙ্গবন্ধুর লেখা নিয়ে প্রকাশিত বইগুলোর তথ্যগুলো কীভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন সেটা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা বা তাঁর সংশ্লিষ্ট দেশে-বিদেশের ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে তা প্রকাশের পরিকল্পনার কথাও এ সময় তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
চেষ্টা করছি পাকিস্তান থেকে তথ্য উদ্ধার করার : বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সংসদকে জানান, ’৭১ সাল থেকে আমরা উনার কোনো লেখা পাইনি। কারণ একাত্তর সালে উনি কারাগারে (পাকিস্তানে)। সেখানে কীভাবে ছিলেন, কী অবস্থায় ছিলেন, আসলে তার কিছু আমরা জানি না। সামান্য একটা লাইন পাওয়া গেছে, আইয়ুব খানের ডায়েরিতে; অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত এটা। সেখানে উনার সম্পর্কে কিছু কমেন্ট করা আছে। বঙ্গবন্ধুকে যখন কোর্টে নিয়ে আসা হতো, উনি আসতেন, দাঁড়াতেন, বসতে বললে বসতেন। উনি এসে দাঁড়িয়েই নাকি ‘জয় বাংলাদেশ’ বলতেন। বলতেন ‘আমাকে যা খুশি তাই করো। আমার যেটা করার আমি তা করে ফেলেছি। অর্থাৎ আমার বাংলাদেশ তো স্বাধীন হবেই’। এর বাইরে একাত্তরের কিছু আমি পাইনি। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখনো আমার চেষ্টা আছে ওখান (পাকিস্তান) থেকে কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা। আর আমি জেলখানায় ছবি আনতে গিয়েছিলাম। জেলখানা ভেঙে নতুনভাবে করা হয়েছে। ছোট্ট একখানা দেয়ালের ছবি পেয়েছি। আর কিছু পাইনি। তবে আমার চেষ্টা আমি করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লাসিফাইড রেকর্ড সংগ্রহ করেছি। যেখানে বাংলাদেশের বিষয়টি রয়েছে। সাউথ এশিয়ার কিছু বিষয় আছে। অনেকগুলো কাগজ। বিশাল। এগুলো আমার অফিসে ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে একটা সুবিধা হয়েছে। ঘরে থাকার কারণে সেগুলো সব ধীরে ধীরে দেখছি। সেখানে ওই সময়কার কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই চেষ্টা করছি