পুলিশের তদন্তে অপরাধ প্রমাণ হলে হত্যা মামলা

অপরাধ

সদরঘাটের কাছাকাছি বুড়িগঙ্গা নদীতে এমএল মর্নিং বার্ড লঞ্চডুবির ঘটনায় তদন্ত কমিটির ২০ সুপারিশ প্রকাশ করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। তবে লঞ্চডুবির জন্য দায়ীদের নাম প্রকাশ করেনি। মন্ত্রণালয় বলেছে, তদন্ত কমিটির পুরো প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে পুলিশের চলমান তদন্ত ব্যাহত হতে পারে। তবে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তদন্তে ৩০২ ধারায় অপরাধের প্রমাণ বেরিয়ে এলে হত্যাকাণ্ডের ধারায় মামলা রূপান্তর হবে। তিনি জানান, কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সদরঘাট এলাকা থেকে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দ্রুতগতির ওয়াটার বাস নামানো হবে। তবে লঞ্চডুবি নিয়ে নৌসচিব জানান, ময়ূর-২ লঞ্চটি লালকুঠি ঘাটে আসার সময় প্রথমে পেছনে পরে মাঝ বরাবর ধাক্কা দিয়ে মর্নিং বার্ডকে ডুবিয়ে দিয়েছে।

বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ সময় নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও নৌসচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বক্তব্য দেন। সোমবার গভীর রাতে নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড ডুবে গেলে ৩৪ জন মারা যান। ওই দিনই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে বলে ওই দিনই জানিয়েছিলেন নৌপ্রতিমন্ত্রী। ওই কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার জন্য ময়ূর-২ লঞ্চের চালকদের প্রধানত দায়ী করা হয়েছে।

রিপোর্ট প্রকাশ নিয়ে নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, দুর্ঘটনার কারণ ও দায়ীদের নাম প্রতিবেদনে আছে। এ ঘটনায় ১৭ আগস্টের মধ্যে আইনি তদন্তের রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ওই তদন্ত যাতে কোনো কারণে বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য আমরা তা প্রকাশ করছি না। ওই ঘটনায় নৌ-পুলিশ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ৭ জনের নামে পেনাল কোডের ২৮০/৩০৪(ক)/৪৩৭/৩৪ ধারায় মামলা করে। এ ঘটনায় ১৭ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

অপর প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যদি তদন্তে বেরিয়ে আসে এটা ৩০২ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার মতো অপরাধ, ডেফিনেটলি তা ৩০২ ধারায় হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা করেছি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করলে কখনও সুশাসন আসে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা নিরাপদ নৌপথ তৈরির জন্য কাজ করছি। নৌযানে ভ্যাসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম (ভিটিএস) স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। তিনি জানান, এই দুর্ঘটনায় জড়িত দুটি লঞ্চেরই ফিটনেস সনদ ছিল। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, অনেক রেজিস্ট্রেশনবিহীন নৌযান যেগুলোর ফিটনেস সনদ নেই।

এই দুর্ঘটনায় দ্রুত বিচার প্রসঙ্গে নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, জনগণের অনুভূতির সঙ্গে চলতে চাই। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবার যেন স্বস্তি পায় সেই ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল আইনের খসড়ায় কার স্বার্থে দুর্ঘটনার সাজা কমানো হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মালিক, শ্রমিক ও জনগণের স্বার্থরক্ষা করতে চাই। তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হবে জানিয়ে নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, সদরঘাট এলাকা থেকে নৌকা সরাতে আগেও পদক্ষেপ নিয়েছি, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি। ডকইয়ার্ড স্থানান্তরের বিষয়েও মিটিং করেছি। এগুলো সরাতে হবে। সদরঘাটে দ্রুতগতির ওয়াটার বাস চালু করা হবে।

এর আগে নৌসচিব মেজবাহ উদ্দিন কমিটির ২০ সুপারিশ পড়ে শোনান। দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, বোগদাদিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে এসে লালকুঠি ঘাটে যাওয়ার সময় মর্নিং বার্ড লঞ্চকে প্রথমে পেছন থেকে পরে মাঝ বরাবর ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয় ময়ূর-২। সুপারিশগুলোর অন্যতম হচ্ছে- সদরঘাট থেকে ভাটিতে ৭-৮ কিলোমিটার এবং উজানে ৩-৪ কিলোমিটার অংশে অলস বার্দিং উঠিয়ে দিতে হবে। এই অংশে পন্টুন ছাড়া নোঙর করা নৌযান রাখা যাবে না।

এ অংশ থেকে পর্যায়ক্রমে শিপইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে। সদরঘাট টার্মিনালের আশপাশে কোনো খেয়াঘাট রাখা যাবে না। ওয়াইজঘাটের উজানে খেয়াঘাট স্থানান্তর করা যেতে পারে। লঞ্চের সামনে, পেছনে, মাস্টার ব্রিজ, ইঞ্জিন রুম ও ডেকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। মাস্টারের দেখার সুবিধার জন্য পেছনে ক্যামেরা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া লঞ্চে পর্যায়ক্রমে ওয়াকিটকি সিস্টেম চালু করতে হবে। লঞ্চ বা জাহাজ ঘাট ত্যাগের আগেই ঘাটে ভয়েজ ডিক্লারেশন দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। লঞ্চে কতজন যাত্রী বহন করা হচ্ছে, ডেক সাইটে এবং ইঞ্জিনে কারা কারা কর্মরত আছে, তা উল্লেখ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল বন্ধ ও সব নদীপথে বিভিন্ন নৌযানের স্পিড লিমিট নির্ধারণ করে দিতে হবে। সানকেনডেক লঞ্চ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে দিয়ে প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে এগুলো চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে যথাযথ সনদধারী মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়া নৌযান পরিচালনা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ডিসপেনসেশন সনদ গ্রহণের প্রথা বাতিল করতে হবে। উৎসবসহ সব সময়ের জন্য প্রত্যেক লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি বন্ধ করতে হবে। টিকিট প্রদর্শন ব্যতীরেকে কোনো যাত্রীকে লঞ্চে উঠতে দেয়া যাবে না। নৌ-আইন অমান্যকারীদের শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ যুগোপযোগী করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। নৌ-দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে দায়ী মাস্টার, ইঞ্জিন ড্রাইভারদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করতে হবে। নৌ-পুলিশের জনবল বাড়াতে হবে। নৌ-ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *