এক-এগারোর ঝড় এবং উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়া শেখ হাসিনার নৌকা

প্রচ্ছদ রাজনীতি

albd.org থেকে :

২০০৭ সালে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতা দখলের অব্যাহত প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এক উত্তাল পরিবেশ সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। ১১ জানুয়ারি বিকাল থেকে পর দ্রুত ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। বেসামরিক ও সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য। মাইনাস টু ফর্মুলার নামে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা চলতে থাকে। অবশেষে, ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাকে। বর্ষার বৃষ্টিভেজা দিন ছিল সেটি। কাকডাকা ভোরে হুড়মুড় করে সুধাসদনের প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। একটি সাজানো মামলায় দ্রুত তাকে গ্রেফতার করে বন্দি করা হয়।

এর আগে, ১৫ জুলাই সন্ধ্যার পর থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনের চারপাশে অবস্থান নেয় হাজার খানেক পুলিশ, র্যাব, ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য। শুনশান মাঝরাতে প্রত্যাহার করা হয় তার বাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থাতেই ফজরের নামাজ আদায় করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এরপর বের হয়ে আসেন একটি শুভ্র শাদা শাড়ি পরে। ১৬ জুলাই, সকাল সাড়ে ৭টা, একটি সাজানো মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয় সিএমএম কোর্টে। বিশেষভাবে দ্রুত আদালত বসিয়ে তার জামিন আবেদন খারিজ করে, বন্দি করা হয় সংসদ ভবন এলাকার সাবজেলে। ব্যাস, ৫৫ হাজার বর্গমাইলের পুরো বাংলাদেশটাই বন্দি হয়ে গেলো। কিন্তু তারা জানতো না যে, এই বাংলাদেশ কখনো বন্দি থাকে না। তাই শেখ হাসিনার গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রতিবাদ শুরু হলো দেশজুড়ে। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ কর্তৃক দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা এবং রাজনীতিবিদরা হয়রানির শিকার হওয়ায়, কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে আন্দোলন চালাতে থাকেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, বিদেশী কূটনীতিক সবাই শেখ হাসিনার মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিতে থাকেন। অবশেষে তীব্র জনদাবির মুখে, ৩৩১ দিনের অবরুদ্ধ সময় শেষে, ২০০৮ সালের ১১ জুন, শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুপুরের পর একটি গাড়িতে করে শেখ হাসিনাকে তার বাসভবন সুধাসদনে পৌঁছে দিয়ে আসা হয়।

এরপর, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন তিনি। গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকেন আপামর জনতা। যার ফলে, ক্রমেই সংকুচিত হতে শুরু করে প্রায় দেড় বছর ধরে দাপিয়ে বেড়ানো তত্ত্বাবধায়কের কতিপয় সামরিক ও তথাকথিত সুশীল সিন্ডিকেট। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় সেনাসমর্থিত ইয়াজউদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকার। ফলে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আয়োজিত হয় ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশ (২৫৭) আসনে জয় লাভ করে। আওয়ামী লীগ একাই অর্জন করে ২৩০টি আসন। শেখ হাসিনার হাত ধরে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তার গতিশীল নেতৃত্বে গতি পায় বাংলাদেশ। ফলে বহুল কাঙ্ক্ষিত ও স্বপ্নের সোনার বাংলার লক্ষ্য অর্জন শেষে, এখন বিশ্বের বুকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ, গ্লানি ঘুচিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাঙালি জাতি।

শেখ হাসিনা: আওয়ামী লীগের দেদীপ্যমান সূর্য

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বাঙালির মুক্তির ম্যান্ডেট এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এরপর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দানকারী এই দলটিকে। ঘনকালো আঁধারে ঢেকে যায় পুরো দেশ। স্বৈরাচার জিয়াউর রহমান এবং স্বৈরাচার এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশজুড়ে দুর্বত্তায়ন চালায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। ফ্রিডমপার্টি গঠন করে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। স্বৈরাচারদের শোষণ ও তাদের মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তদের নির্যাতনে অস্থির হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ এই রাজনৈতিক দলকে। সংবিধানের চার প্রধান স্তম্ভকে পদদলিত করে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। উত্থান ঘটে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর।

ঠিক এমন এক বিপদসংকুল সময়ে, আওয়ামী লীগের হাত ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পিতার প্রতিষ্ঠা করা দেশের মানুষের জান-মাল রক্ষার জন্য, নিজের জীবন বিপন্ন করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি। এরপর, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর, রাজপথে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো জনপ্রিয় ভোটে এগিয়ে থাকলেও, সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। তবে বিরোধী দলের আসনে বসেও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন। অবশেষে শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের কারণেই দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসে। সেই থেকে তিনি আমাদের গণতন্ত্রের মানসকন্যা। শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক আলোকিত নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।


এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে সরকারে নিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার দক্ষ শাসনামলে প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বাংলাদেশ। দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশ বিশ্বের বুক থেকে মুছে দেয় তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ৫০ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৯ লাখ মেট্রিক টন বেশি। এমনকি ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যাপরিস্থিতিও মোকাবিলা করেন শক্ত হাতে। দেশের ৭০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে যাওয়ায়, বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় বলা হয়েছিল- অসুখে ও খাদ্যাভাবে এক কোটি মানুষ মারা যাবে। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে বন্যাজনিত অভাব বা অসুখে কাউকে প্রাণ হারাতে হয়নি। শেখ হাসিনার এই শাসনামলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে উঠে আসে বাংলাদেশ। আধুনিক বাংলাদেশে দক্ষ সুশাসকের প্রতীক হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা।

কিন্তু দেশের স্বার্থ বিকিয়ে না দেওয়ায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে, দেশবিরোধী চক্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রীদের যোগসাজসের কারণে হারতে হয় আওয়ামী লীগকে। বহুমুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেও জনপ্রিয় ভোটের হিসেবে আওয়ামী লীগ ৪০.০২ শতাংশ ভোট অর্জন করে, বাকিরা জোট করেও মাত্র ১.৩৮ শতাংশের বেশি ভোটে আওয়ামী লীগকে পিছিয়ে ফেলতে পারেনি। এই আমলে দেশকে অপরাধ ও উগ্রবাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে বিএনপি-জামায়াত জোট। গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে একাত্তরের খুনি ও ধর্ষক রাজাকাররা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তারেক রহমানের পরিকল্পনায় শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক নৈরাজ্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এক পর্যায়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ফলে, দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে, নামকাওয়াস্তে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি এক সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করে তারা। এর আগেও, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় সাজানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। পরবর্তী পরিস্থিতিতে একই বছরের ১২ জুন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ৪ শতাংশের বেশি ভোটে বিশাল জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ।

২০০৭ সালেও কুচক্রীদের সাজানো নির্বাচনের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের শোষণের বিরুদ্ধে জনরোষ, খালেদা-তারেক গংদের হঠকারিতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে দেশে সৃষ্টি হয় এক নতুন সংকট। সামরিক নেতৃত্বের সহায়তায় ক্ষমতা গ্রহণ করে তথাকথিত সুশীলদের ব্যানারে এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রচিত হয় কলঙ্কজনক ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারোর পটভূমি। মাইনাস টু ফর্মূলার নামে মূলত মাইনাস ওয়ান তথা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মরিয়া ওঠে এরা। এর আগে, ২০০৪ সালের তারেক রহমানের নির্দশনার গ্রেনেড হামলা করে হত্যার চেষ্টা করা হয় তাকে। সেসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু চিরস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তার কান ও চোখ। এই চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হতো তাকে। সেই চিকিৎসার জন্যই ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন তিনি। এই সুযোগে তার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

রাজনীতি ও দেশ থেকে নির্বাসনে গিয়ে, বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু তিনি সব প্রলোভন প্রত্যাখান করেন। দেশের পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে, দ্রুত চিকিৎসা শেষ করে, গ্রেফতারের হুমকি পরোয়া না করে, অমিত বিক্রমে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তুমুল হর্ষধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ নেন বাংলার জনতা। শুধু বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার আপসহীন মনোভাবের কারণেই, বাংলাদেশের গণতন্ত্র লুট করার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, একটি সাজানো মামলায় তাকে অবৈধভাবে আটক করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রিয় নেত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ঝিনাইদহ, নাটোর, চাঁদপুর ও ভোলার মোট চার জন ব্যক্তি। দেশজুড়ে ক্ষোভ সঞ্চার হয়। নিঃসঙ্গ জেলে চিকিৎসাহীন অবস্থায় রেখে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু তবুও মানসিকভাবে অবিচল ছিলেন তিনি। অবশেষে, ৩৩১ দিনের অবরুদ্ধ সময় শেষে, ২০০৮ সালের ১৬ জুলাই, শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় কুচক্রীরা। জনগণের মধ্যে ফিরে আসেন জননেত্রী। দ্রুত নির্বাচনের জন্য তীব্র জনদাবি গড়ে তোলেন। ফলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে ইয়াজউদ্দীন-ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের সরকার। এই নির্বাচনে একচেটিয়াভাবে ভাবে জিতে, অন্ধকারে ছেয়ে থাকা দেশকে আলোক বন্যায় ভাসান বঙ্গবন্ধুকন্যা।

শেখ হাসিনা, যার আলোয় নতুন রূপে জ্বলে ওঠার প্রেরণা পেয়েছে আওয়ামী লীগ; কিন্তু তিনি শুধু একটি দলের প্রধান নন, শেখ হাসিনা- আপামর বাঙালির আবেগের নাম। অন্ধকার রাতে তুমুল আলোর ঝলক তিনি, তার হাত ধরেই নতুন করে ফিরে এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ। আজকের এই আধুনিক বাংলাদেশ পুরোটাই শেখ হাসিনার অবদান।

১/১১ এর ষড়যন্ত্র, ৩৩১ দিনের বন্দি জীবন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন:

বিএনপি-জামায়াত জোটের সীমাহীন ষড়যন্ত্রে এই দেশ যতবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ততবারই ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন রূপে ফিরে এসেছে প্রিয় দেশ। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি কখনো। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই মিথ্যা মামলায় দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে জেলে ঢোকানোর পর, খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরপর ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। নির্জন কারাগের তখন কাউকে দেখা করতে দেখা হতো না তার সঙ্গে। অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রচণ্ড একাকী ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তবুও বিচলিত হননি। উল্টো ৩৩১ দিনের জেলজীবনে নিয়মিত ডায়েরি লিখে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প তৈরি করেছেন। যখনই কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, তিনি দেশবাসীর জন্য কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আবারো নির্বাচনের বিজয়ের মাধ্যমেই ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের খবর শুনেই প্রথম দিন দেশের চার জেলায় চারজন ব্যক্তি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। দেশজুড়ে প্রতিদিনই আন্দোলন-সংগ্রাম-প্রতিবাদ চলতে থাকে। এক সপ্তাহের মাথায়, ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়।

দেশজুড়ে এই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী লুটপাটকারী ও ক্ষমতালিপ্সু বিএনপি-জামায়াত। তাদের দুঃশাসনের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, সংবিধান মেনে একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল। কিন্তু অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল রাখতে, বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির স্বজন ও সাবেক একজন বিএনপি নেতাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বসানোর পাঁয়তারা করেন খালেদা জিয়া। এ ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানায় আওয়ামী লীগ। সংবিধান অনুসারে একজন নির্দলীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে এই পদে বসানোর দাবি জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা ও তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ২৯ অক্টোবর রাতে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিএনপি সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ফলে সৃষ্টি হয় সাংবিধানিক সংকট।

এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই, বিএনপি-জামায়াতের হুকুমে ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করেন নির্বাচন কমিশন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দমনের উদ্দেশ্যে, ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের আদেশে দেশে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সাজানো নির্বাচনের ছক থেকে সরে না আসায়, ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। এরপর, ৫ জানুয়ারি, লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে আসন্ন একতরফা নির্বাচনকে অর্থহীন বলে অভিহিত করা হয়।

এদিকে দেশজুড়ে উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নেয় সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে তিন বাহিনীর প্রধান এবং আরো কিছু সেনাসদস্য বঙ্গভবনে যান। তাদের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি নেন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। সেই রাতেই ফখরুদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করেন তারা। এরপর ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের সামনে রেখে, সরকার পরিচালনা করতে থাকেন মইন ইউ আহমেদ এবং সামরিক সদস্যরা। এরপর রাজনীতিবিদদের গণগ্রেফতার করে, দীর্ঘমেয়াদে দেশের ক্ষমতা দখলের ছক আঁকেন তারা। দেশজুড়ে বেজে ওঠে অশুভ ঘণ্টা। শারীরিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ নেত্রী শেখ হাসিনাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্জন কারাগারে বন্দি করে কৌশলে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়।

২০০৭ সালের সেই আগস্টজুড়ে ভয়ানক বন্যা শুরু হয় দেশে। সেসময় চিকিৎসাহীন অবস্থায় জেলে দিন কাটাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। আইনজীবীরা মামলার ব্যাপারে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে, তিনি তাদের মাধ্যমে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। এমনকি যে সরকারের রোষানলে তাকে জেলে বন্দি থাকতে হচ্ছিলো, গণমানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সেই সরকারকেও সহযোগিতা করতে বলেন তিনি। নেত্রী বলেন, ‘এবারের বন্যা ১৯৯৮ এর চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সরকারের একার পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নাহলে বন্যা সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে।’ কারান্তরীণ থেকেও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি ব্যাপকভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা দেন তিনি। শেখ হাসিনা এ কারণেই অনন্য, গণমানুষের প্রয়োজনে নিজের জীবন ও রাজনীতিকে তুচ্ছ করতে পারেন তিনি।

এদিকে গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কান ও চোখের চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েন নেত্রী। কিন্তু তাকে উন্নত চিকিৎসা থেকে বিরত রাখা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের মার্চের শেষ দিন আদালতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি আইনজীবীদের বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পারিনি। এখন বিনাচিকিৎসায় মারার চেষ্টা করছে।’ এসময় তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭১ সালে সন্তানসম্ভবা ছিলাম। পাকিস্তানিরা মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে দেখা করতে দেয়নি। এখন এরা চিকিৎসাসেবা ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না। আমার ওপর যে অবিচার করা হয়েছে, তার ভার আমি আল্লাহ ও জনগণের ওপর দিচ্ছি।’

সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় সময়ের সাথে সাথে অসুস্থতা বাড়তে থাকে নেত্রীর। অবশেষে তাকে হাসপাতালেও থাকতে হয় প্রায় তিন সপ্তাহ। ২০০৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, আদালতে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পরিস্থিতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।

এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুরুতে রাজনীতিবিদদের যেভাবে হয়রানি শুরু করেছিল, সেই পরিস্থিতি সামলাতে কিছুটা সময় লাগে নেতাকর্মীদের। এই সময়েও সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে নিয়মিত শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। ২৭ ও ২৮ মে, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় গণগ্রেফতার। প্রায় ২০ হাজার কর্মীকে আটক করা হয়। কিন্ত তবুও দমানো যায়নি। অবশেষে জননেত্রীর ব্যক্তিত্বের সামনে সেনাসমর্থিত সরকারের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। তারা শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয় বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে। এমনকি গাড়িতে করে তার বাসভবন সুধাসদনে পৌঁছে দিয়ে আসা হয় তাকে।

জেল থেকে ছাড়া পেয়েই বাংলার মানুষের ভাগ্য বদলের উদ্যোগ নেন তিনি। ‘দিন বদলের সনদ’ নামে নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেন। কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নিখুঁত পরিকল্পনার প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল এটি। নিঃসঙ্গ জেলে বসে দেশের মানুষের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ইশতেহারের রূপকল্প তৈরি করেন শেখ হাসিনা।

জননেত্রী শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্বের গুণে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে, ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে টানা তৃতীয় বার ও মোট চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার পুরো মেয়াদকালে এই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ করেন তিনি। সমৃদ্ধির পথ ধরে দেশ এখন এউন্নত বিশ্বের দিকে ধাবমান…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *