মহাজাতকের মহা প্রতারণায় প্রধান হোতা অনোয়ার

অপরাধ

মো: মাজহারুল পারভেজ>

জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রতারণা করে যাচ্ছেন মহাজাতক শহীদ আল বুখারী। জন্ম-তারিখ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় তাঁর এ প্রতারণা। এরপর আর থামেননি। ঝাড়ফুঁককে পুঁজি করে শহীদ সিকদার ওরফে দুলু থেকে বুখারী। এরপর গুরুজী। এই গুরুজী থেকে এখন তিনি মহাজাতক। তাঁর নানা লোভ-লালসা ও ভোগদখলের কারণে পাহাড়েও অশান্তি বিরাজ করছে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে অনেকেই গৃহহীন। শুধু তাই নয়, মসজিদের টাকা আত্মসাৎ ও এতিমখানার জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই দখলদারের বিরুদ্ধে পাহাড় ও গাছ কাটার অভিযোগও রয়েছে। পাহাড় কেটে মাটি ভরাট এবং গাছ কাটার ফলে ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। এসব অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে।
জীবনের ধাপে ধাপে প্রতারণা

মহাজাতক তাঁর লোক লাগিয়ে দেন মানুষের পেছনে। পুরুষকে ফোন দেয় নারী দিয়ে আর নারীকে ফোন দেয় পুরুষকর্মী দিয়ে। কোর্স করতে প্ররোচিত করে দিনের পর দিন লেগে থাকে। মহাজাতক অন্যান্য পীরদের মতো বাবা, মুর্শিদ কেবলার স্থলে ‘গুরুজী’ উপাধি নিয়ে অনুসারীদের মাঝে নিজ আসন মজবুত করেছেন। নিজেকে পীর ওলী হিসেবে পরিচিত না করে গুরুজী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মধ্যে রয়েছে তার মহা প্রতারণা। বিভিন্ন ধর্মের লোকজনই গুরুজীর সান্নিধ্য পেতে চায়।

তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে রয়েছে প্রতারণা। প্রকাশ্যে তিনি যা করেন সবই লোক দেখানো। মেডিটেশনের কথা বলা হলেও ধর্মকে পুজি করেই তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কোয়ান্টামে দান করলে চাকরিতে বদলি, সন্তান ও অবাধ্য ভাই-বোন ও বন্ধুকে আপন করতে, সম্পর্কন্নোয়ন, পরীক্ষায় সাফল্যলাভ, সন্তানলাভসহ যেকোনো সমস্যা সমাধানে মাটির ব্যাংকে দানের কথা বলা হয়ে থাকে। ধর্মকে ব্যবহার করে অনলাইন ও অফলাইনে কোটি কোটি টাকা দান গ্রহণ করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। একাধিক ভুক্তভোগী দৈনিক নিখাদ খবরকে জানিয়েছেন, তার সবই ভূয়া।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সেবামূলক ফাউন্ডেশন, যোগ ফাউন্ডেশন একটি লিমিটেড কোম্পানি। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকই তারা স্বামী-স্ত্রী। কেবল মাটির ব্যাংকের কিছু টাকা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে জমা হয়। মেডিটেশনের কোর্স-ফিসহ যাবতীয় অন্যান্য ফি জমা হয় যোগ ফাউন্ডেশনে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কোনো কোর্স আয়োজন করলেও টাকার রশিদ দেওয়া হয় যোগ ফাউন্ডেশনের।

আয়কর ফাইলে সম্পদের গড়মিল

২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোয়ান্টামের নিট সম্পদ দেখানো হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৪ লাখ ২ হাজার ৯৫২ টাকা। এতে অনুদান দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৬ টাকা । ট্যাক্স প্রদান করেছে ৭১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৯১ টাকা। জমি ও দালানকোঠার মূল্য দেখানো হয়েছে ৪০ কোটি ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৫২ টাকা। নগদ ও ব্যাংকে জমা আছে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৮৬ হাজার ৮০৯ টাকা ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে শহীদ আল বুখারী তার নিজের আয়কর ফাইলে নিট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন ৫ কোটি ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৩৮০ টাকা। আয়ের উৎস হিসেবে সেলারি ইনকাম দেখানো হয়েছে ২৭ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যান্য আয় ২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪ টাকা। ট্যাক্স প্রদানের মতো মোট আয় ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৪ টাকা। ট্যাক্স প্রদান করেছেন ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩০ টাকা। ইয়োগা ফাউন্ডেশনে শেয়ার ক্রয় করা আছে ৫৮২০টি, যার আনুমানিক মূল্য ৫৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। বছরান্তে ব্যয় করেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ব্যাংকে এফডিআর রয়েছে ১ কোটি ৫১ লাখ ৪৬ হাজার ৯২৫ টাকার। পারিবারিক ব্যয় ২১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫০ টাকা। হাতে নগদ ও ব্যাংকে রয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ৮৮ হাজার ৪৫৫ টাকা।

বাপ-দাদার ভিটায় অসহায় পাহাড়ীরা
মহাজাতক ও তাঁর অনুসারীদের নানাবিধ নির্যাতনের ফলে বাপ-দাদার ভিটায় অসহায় হয়ে পড়ছেন স্থানীয় পাহাড়ীরা। ইতোমধ্যে বাড়িঘর ছেড়ে অনেকেই চলে গেছেন। তার এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই শুরু হয় মামলা ও হামলা।

লামা উপজেলার লাম্বা খোলা শাহ আমজাদিয়া মসজিদ, মাদ্রাসা, হাফেজখানা ও কবরস্থান পরিচালনা কমিটির পরিচালক সমাজসেবী আব্দুল গফুর এ প্রতিবেদককে বলেন, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে ভূমিখেকো শহীদ আল বোখারী আমাদের মসজিদ,কবরস্থান ও মাদ্রাসার ১০ একর জমি দখল করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে আদলতে একটি মামলাও রুজু করা রয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থানের জমি ছাড়াও তিনি এতিমদের জমি দখল করেছেন।

উপজেলার সরই ইউনিয়নের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আদিবাসী রেংনী মুরুং এর জায়গা জবরদখল করে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে বোখারীর বিরুদ্ধে। দখল করার অভিযোগ রয়েছে এ্কই ইউনিয়নের মৃত আব্দুস সালাম মিয়ার জমি। জমি দখল করার জন্য মামলা ছাড়া পুলিশ দিয়ে সালাম মিয়াকে আটক করে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে মহাজাতকের বিরুদ্ধে। এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

মারা যাওয়ার পর বিধবা স্ত্রী রহিমা বেগমও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বোখারীর বেতনভুক্ত সন্ত্রাসীদের হাতে। বিধবা রহিমার ভাই সিএনজি চালক রফিকুল ইসলাম জানান, তার বাবা আব্দুর রশীদের নামে আর/৬২৫ হোল্ডিংয়ের ৪.৫০ একর ও আরো ২ কানি খাস জমি জোরপূর্বক সন্ত্রাসীদের দিয়ে দখল করে নিয়েছে মহাজাতক। এ বিষয়ে তিনি লামা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছেন। সিআর মামলা নং-৪৯, তারিখ- ১৮ মার্চ ২০২০ইং।

লামার কেয়াজুপাড়ার মো. খলিলুর রহমান বাদি হয়ে ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ আল বোখারীর নামে একাধিক মামলা করেছেন। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর মো. নাছির উদ্দীন বাদী হয়েও মামলা করেন। এছাড়া পাহাড় কাটাসহ শহীদ আল বোখারীর বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে।

মসজিদের টাকা আত্মসাৎ
দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে অনুদান সংগ্রহ করছেন মহাজাতক। তার প্রায় ৫ লাখ কোয়ান্টাম সদস্য থেকে দান অনুদান তোলার পাশাপাশি দেশ বিদেশ থেকে প্রায় শত কোটি টাকা অনুদান গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে মসজিদে এখনো সেই পুরনো টিনের চালা, নেই দেয়াল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ১৪ বছরে কম করে হলেও ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে এই মসজিদ নির্মাণ করার জন্য। মসজিদের কোনো উন্নয়ন না হলেও প্রতিবছর পাহাড়ে জমি বাড়ছে মহাজাতকের।

রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা কোয়ান্টামের সাবেক অর্গনিয়াম নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিখাদ খবরকে জানান, তাঁর হাত ধরেই এ মসজিদে প্রায় ২০ কোটি টাকা এসেছে। মায়ের চিকিৎসা না করে মায়ের ইচ্ছায় তিনিও মসজিদের জন্য দুই দফায় ১০ লাখ টাকা দান করেছেন। দানের টাকার এসব রশিদও রয়েছে নিখাদ খবরের কাছে।

জমি দখল করায় একাধিক মামলা
লামা রাবার ইন্ড্রাষ্ট্রিজ-এর পরিচালক অপারেশন কামাল উদ্দিন নিখাদ খবরকে বলেন, পাহাড়ে কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে সরকার থেকে ২৫ একর জমি লিজ নিয়ে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় সরই ইউনিয়নের ডলুই ছড়ি মৌজায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে তুলেন। এখন এই কারখানার জমির পরিমাণ ১৬০০ একর। পুরো জমিতেই বাণিজ্যিকভাবে রাবার চাষ শুরু। এরই মধ্যে দুই দফায় শহীদ আল বোখারী তাদের কারখানার ৫০০ একর জমি দখল করে নিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। দখলি জমিতে তিনি ঘর করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মুরুং ত্রীপুরাদের ৩৭টি পরিবারকে থাকতে দিয়েছেন। এখন এই গোষ্ঠি তার লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজে হামলা করে শান্তিপূর্ণ পাহাড়ি পরিবেশ অশান্ত করে তুলেছেন এই মহাজাতক। ধ্বংস হচ্ছে স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ। স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন। এ হামলা ও জবরদখলের ফলে তাদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রুজু করা হয়েছে।

কামাল উদ্দিন জানান,বোখারী উল্টো তাদের বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিল। প্রমাণ দেখাতে না পারায় বোখারীর মামলাগুলো খারিজ হয়ে গেছে। পাড়াড়ে যত অবৈধ সম্পদ দখল ও মানুষকে নির্যাতন করেছে, এর মহানায়ক কোয়ন্টাম মমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আনোয়ার আল হক। শহীদ আল বোখারীর নির্দেশে সে কোয়ান্টামের পুরোনো ঘরে অগ্নিসংযোগ করে নিরীহ মানুষকে পুলিশি নির্যাতন করেছে। তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মহাজাতকের সব অনিয়ম ও রোমহর্ষক অপরাধের ঘটনা জাতি জানতে পারবে।

(পরবর্তী পর্বে আসছে – কে এই আনোয়ার?)

1 thought on “মহাজাতকের মহা প্রতারণায় প্রধান হোতা অনোয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *