মহাজাতকের মহা অনিয়ম (প্রথম পর্ব)

অপরাধ
  • মো: মাজহারুল পারভেজ>>

মাথায় নেপালি টুপি,বড় মোচ ও সাদা আলখেল্লা পরিহিত এক অকাল্ট পাহাড়ি সাধক। নিজেকে যুগসংস্কারক, ধর্ম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক ডিজিটাল গুরু পরিচয়ে দানের টাকা গ্রহণ করছেন। আশির দশকের এই জ্যোতিষী ও গণকের নাম ছিল শহীদুল আলম সিকদার দুলু। নাম পরিবর্তন করে হয়েছেন শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। মহাজাতকের পাশাপশি তার স্ত্রী আফতাবুন্নেছা অরুনা নাম পরিবর্তন করে হয়েছেন মা’জি নাহার আল বুখারী।

আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে দেশ ও বিদেশ থেকে নানাভাবে প্রতারণা করে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন দানের শতকোটি টাকা। দানের টাকায় পাহাড়ে গড়েছেন বিশাল সাম্রাজ্য ।

ভুল তথ্য দিয়ে পাহাড়ে জমি ক্রয় করেন ২০০০ সালে। এরপর নিজেকে ‘ধর্ম প্রচারক’ দাবি করে পাহাড়ে শুরু করেন যাতায়াত। অথচ ধর্মের লেশমাত্র নেই তার কোন কাজ কর্মে। কাগজে কলমে পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও তিনি বসবাস করেন রাজধানীতে। খোদ রাজধানীতে বসেই মানবসেবার নামে সাধারণ মানুষের সাথে করছেন ভয়াবহ প্রতরাণা। দান ছদকা যাকাত ও অনুদানের টাকায় বান্দরবানের লামায় ৬ হাজার একর জমি কিনেছেন। প্রতারণা ও জোর জবরদস্তি করে দখলে রেখেছেন আরও দুই হাজার একর জমি। আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠী এবং আদি ও স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীদের মোট ৮ হাজার একর জমি এখন এই শহীদ আল বোখারীর দখলে।

এছাড়াও রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও পবাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে বেনামে তার বিশাল সম্পদ রয়েছে।

এত অর্থ সম্পদ অর্জন করার পরও মাটির ব্যাংক, এতিমান, দাফন বা সৎকারের জন্য দান, সাদকা, হিলিং, অনুদানসহ ১২২টি খাতে দেশ ও বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত দান গ্রহণ করছেন এই মহাজাতক।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, ব্যাংকে ও তার হাতে রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। পাহাড়সম সম্পদ থাকলেও আয়কর ফাইলে সম্পদের পরিমাণ অতি নগণ্য। বিশ্বের অন্তত ৪৭টি দেশ থেকে অবৈধভাবে ও দেশের ৬৪ জেলায় ৪০০ বুথ থেকে প্রকাশ্যে দানের কোটি কোটি টাকা আসছে কোয়ান্টামের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর শান্তিনগরে।

সংগ্রহ করা এ বিশাল টাকার আয়ব্যায়ের কোনো হিসাব কখনো দেখান না তিনি। তোয়াক্কা করেন না সরকারি কোনো নিয়মনীতির, তার প্রতিষ্ঠানে করানো হয় না কোন অডিট। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্পদ গড়েছেন তাঁর অনুসারীদের নামেও।

অনুসন্ধানে জানা যায়,কোয়ান্টামের মেডিটেশন কোর্স করতে ১১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়। প্রতি কোর্সে প্রায় দেড় হাজার প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করেন। সারা দেশে প্রতি বছর ২০টি কোর্স পরিচালনা করেন মহাজাতক। এই কোর্স থেকে কোটি টাকা আয় করে সরকারকে ট্যাক্স প্রদান না করারও অভিযোগ রয়েছে এই মহাজাতকের বিরুদ্ধে। মেডিটেশন শেখানোর নামে মানুষকে হিপনোটাইজ করে দাসে রূপান্তরিত করার অভিযোগও উঠেছে এই ডিজিটাল গুরুর বিরুদ্ধে।

যা বলছে প্রশাসন

বান্দরবান জেলা জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন নিখাদ খবরকে বলেন, আসলে ওনার যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আছে এতে কোনো সন্দেহ নাই। আমি আসলে অনেস্টলি বলি, কোয়ান্টাম আসলে এত সম্পদ কোথা থেকে পেলো স্থায়ী কমিটিতে এটা আলোচনা হয়েছে একাধিকবার। এখানে রাখঢাকের কিছু নাই। যেটা সত্য সেটাই বলতেছি। আমারও একটা জানার আগ্রহ এত সম্পদ কীভাবে করেছেন তিনি । পুরো বাংলাদেশ একটা সিষ্টেমে চলে। ৯৬ বা ৯৭ যদি বলে দেয়া থাকে, এত বিঘার বেশি সম্পত্তি কেউ অর্জন করতে পারবে না। তবে তার বেলায় কেন এই ভারটা নাই। এটা আসলে দেখা দরকার। তবে দেখার জন্য এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছি।

আমি এখানে থাকি আর না থাকি, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমি এটা করে যাবো ইনশাআল্লাহ। এখানকার উপজাতি যারা আছেন,বিশেষ করে লামা এলাকায়, তাদের গণ্ডগোলের একটা বড় কারণ শহীদ আল বোখারীর জমির টানাহ্যাচড়া। এসব অবশ্য আলোচনায় আসছে। আরেকটি বিষয় হলো, এখানে কোয়ান্টাম নামে কিন্তু তারা চালাচ্ছে না। এটা কোয়ান্টাম মম নামে চালাচ্ছে। এখানে একটা প্যাচ লাগিয়ে দিয়েছে ওরা। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির সভায়ও আমি এসব প্রশ্ন তুলে প্রতিকার চেয়েছি।

বান্দরবানে তার জমি ক্রয় প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০০০ সালেরও আগে নির্বাচন কমিশন বা চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র বা কিছু একটা দিয়েছেন তিনি। তখন তো আর ভোটার আইডি কার্ড ছিল না। ছোট্ট কিছু একটা দিয়ে এখানের ভোটার হয়েছেন বোখারী ও তার স্ত্রী। এরপর জমি ক্রয় করেছেন।

প্রভাশালীদের যাতায়াত রয়েছে আশ্রমে

আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম , সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনঘন যাতায়াত ছিল মহাজাতকের লামার কেয়াজুপাড়ার আস্তানায়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতাকর্মী , স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়াসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল মহাজাতকের খানকায়।

এলাকাবাসী জানায়, সাবেক সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈ সিং ব্যতিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাশালী ব্যক্তিবর্গসহ  মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের যাতায়াত রয়েছে তার কাছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রবেশাধিকারদের কোনো অনুমতি নেই এখানে ।

মিথ্যা তথ্য প্রদান করে পাহাড়ে জমি ক্রয়

২০০০ সালের ০৩ অক্টোবর মিথ্যা ও জাল তথ্য প্রদান করে বান্দরবান সদর উপজেলার ৩১৩ নং মৌজায় ৮৭৩ নং হোল্ডিং এ কাশেমপাড়ায় ১০ শতক জমি ক্রয় করেন আব্দুল মান্নান সিকদারের ছেলে শহীদ আল বোখারী। জমির দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৫ হাজার টাকা। তিনি তখন নিজেকে বান্দরবানের পৌর এলাকার বাসিন্দা দেখিয়েছেন। বান্দরবান পৌরসভার তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান কর্তৃত জাল সনদ ও সংগ্রহ করেন। এ প্রত্যয়ন পত্রের বলে পার্বত্য চট্রগ্রামের শাসনবিধি ১৯০০এর ৩৪(৪) বিধিমতে বিক্রয় সূত্রে নামজারীর অনুমোদন দেয় তৎকালীন জেলা প্রশাসক। জমি ক্রয়ের আবেদনে যে স্বাক্ষর করেছেন সেটিও শহীদ আল বোখারীর নয়। এমন প্রমাণ রয়েছে নিখাদ খবরের হাতে।

এরপর থেকেই তিনি নিজেকে বান্দরবানের স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে কয়েক হাজার একর জমি ক্রয় ও দখল করেন। বান্দরানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত তিনি রাজধানীতেই বসবাস করে আসছেন।

প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী বান্দরবানে জমির পরিমাণ ৬ হাজার একর

জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং হেডম্যানদের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, বান্দরবানের লামা উপজেলার ৫নং সরই ইউনিয়নের ৩০৩ ডলুছড়ি মৌজায় শহীদ আল বোখারীর নামে ২৮৬৪ একর জমি । ১নং  গজালিয়া ইউনিয়নের ৩০০ নং বড়বমু মৌজায় রেজিষ্ট্রিকৃত জমি রয়েছে ১৫৫ একর। বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা মৌজায় রয়েছে ১৫৮ একর জমি। এ ছাড়া তার স্ত্রী মা’জি নাহার আল বোখারী,পাহাড়ী অনুসারী থোয়াই অং চাক, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, কোয়ান্টাম মম, ও কসমো স্কুল এন্ড কলেজের নামে রয়েছে আরও ৩ হাজার একর জমি।

দখলে আছে আরও ২ হাজার একর জমি

শুধু বান্দরবানে ৬ হাজার একর জমি ক্রয় করার পর আরও ২ হাজার একর জমি জবর-দখল করেছেন বোখারী। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা যায়, নির্যাতন ও নানাভাবে হয়রানি করে শহীদ আল বোখারী কেবল লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রি লিমিটেড এর ৫০০ একর এবং স্থানীয় পাহাড়ী ও বাঙ্গালীদের আরও দেড় হাজার একর জমি জবর দখল করে  নিয়েছেন। জমি দখলের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে আদালতে।  কিন্তু জমির দখল না ছেড়ে দিনের পর দিন তার বেতনভুক্ত সন্ত্রাসীদের দিয়ে অভিযুক্তদের নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন।

(দ্বিতীয় পর্ব আসছে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *