সজল চৌধুরীঃ
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলোর মধ্যে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, জীবন-জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, শোষণহীন সমাজ, ন্যায় বিচার, সামাজিক সাম্যতা, গ্রামীণ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল বৃহৎ কর্মপরিকল্পনার। যেখানে অতি অল্প সময়ে পুনর্বাসন নির্মাণ-পুননির্মাণ, নতুন নতুন অবকাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণ এর মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এর এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ তাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল। জনজীবন যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, খাদ্যাভাব, মানুষের মৌলিক চাহিদা গুলো যেন সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে সক্ষম হয়, নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত হয় প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে এসবের দিকে লক্ষ্য রেখেই কিভাবে সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক মুক্তির দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় এগুলোই প্রথম কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একথা বললে মোটেও ভুল হবেনা, স্বাধীন দেশে এই বৃহৎ নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে অনেক কণ্টকময় পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সময়কে পাড়ি দিতে হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর অবিচল থেকেই বঙ্গবন্ধু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন সদ্য স্বাধীন হওয়া সোনার বাংলাদেশ গঠনকল্পে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল ছিল তার সেই স্বপ্নের যাত্রার অভিমুখে অগ্রসরের খুব অল্প কিছু সময়। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন বিশ্বের ইতিহাসে আজও তা বিরল এবং সকলের অনুকরণীয়। আমরা আজ সেই পথেই চলছি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে।
এবার আসা যাক বর্তমান সময়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। আরেকটি পূনর্বাসনের কথায় আসা যাক। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ভূমিকা। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এবং জাতিসংঘকে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই আহ্বান শুধুমাত্র আজকে জানাননি। এর আগেও তার বিভিন্ন বক্তব্য বিভিন্ন বৈঠকে এই ইস্যুটিকে তিনি বারবার তুলে এনেছিলেন। সম্প্রতি শরণার্থীবিষয়ক ইউএন হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডির সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের কার্যক্রমকে আরো জোরদার করার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আইসিসির প্রসিকিউটরকে এই বলে আশ্বাস দেন যে রোহিঙ্গাদের জন্য জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাদের চলমান সব প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সব সময়ে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।
এমনকি নিরাপদ এবং উপযুক্ত বাসস্থান যে সকল এর মৌলিক অধিকার এবং এই গৃহহীনতার অভিশাপ দূর করতে তিনি বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গত একুশে সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টেকসই এবং সাশ্রয়ী আবাসন বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গৃহহীনতা সমস্যাটিকে সকলের মধ্যে উপলব্ধিতে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন গৃহহীনতা একটি অভিশাপ। শুধুমাত্র উন্নত দেশে নয় উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তিনি তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। তার অভিজ্ঞতাকে সকলের সাথে শেয়ার করেছেন। সকলকে একসাথে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন সাড়ে ১৬ কোটির জনবহুল এই বাংলাদেশ গৃহহীনতার বিষয়টিকে অত্যন্ত সফলভাবে সমাধান করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং বর্তমানে সমস্যার সমাধানও করতে পেরেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ভূমিহীন মানুষজনকে বিনা মূল্যে জমি এমনকি ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোকে ঘর নির্মাণের মাধ্যমে তাদেরকে কর্মক্ষম করে গড়ে তুলেছেন। ঠিক যেমনটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই ভূমিহীন গৃহহীন মানুষগুলোকে পূনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য জননেত্রী ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প চালু করে। যার মাধ্যমে ভূমিহীনদের জন্য আবাসন এর ব্যবস্থাপনা করেন।
গত দুই দশকে বাংলাদেশের সরকার সবার জন্য বিনামূল্যে আবাসন নিশ্চিত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তিনি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামকে উন্নয়ন করতে চেয়েছেন। যে গ্রামে শহরের সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। যে গ্রাম থেকে মানুষ তাদেরকে শীকরকে ছিন্ন করে শুধুমাত্র শহরে যাবার তাগিদে বসে থাকবে না। গ্রামগুলোকে উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে উন্নয়ন করা সম্ভব যদি না মানুষের জীবনযাত্রার মান সেখানে নিশ্চিত করা যায়। আর এই স্বপ্নকে তিনি ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত করছে। শুধুমাত্র গত দুই বছরে দুই লাখের অধিক ঘর নির্মাণ করেছে যেখানে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ গৃহহীন মানুষকে। এতগুলো মানুষের ভালোবাসা কখনো মিথ্যে হবার নয়। পৃথিবীতে এইরকম উদাহরণ আর কত আছে সেটি আমার খুব বেশি জানা নেই।
তিনি বাসস্থান যেন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা এর প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করেছেন। কারণ তার মতে একটি বাসা শুধুমাত্র থাকার জায়গা নয়। এই বাসা-বাড়ি তার অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিকে আরো ত্বরান্বিত করে। মর্যাদার সাথে একটি সমাজে তাকে বসবাস করতে অনুপ্রাণিত করে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যে ভুক্তভোগী মানুষ কিংবা পরিবারগুলো আছে তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কক্সবাজারে বহুতল ভবনে (১৩৯ বহুতল ভবন) তিনি ৫০০০ জলবায়ু শরণার্থী পরিবারকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাই নয় তার প্রধানমন্ত্রীত্বের বিভিন্ন মেয়াদে তিনি পাঁচ লাখের বেশি ঘর নির্মাণ করেছেন। যেখানে প্রায় ৩৫ লাখ গৃহহীন মানুষের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বর্তমানে আরো প্রায় ৫০ হাজার ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে এই ধরনের উন্নয়ন বাংলাদেশে হরহামেশাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
এবার প্রশ্ন জাগে এই ধরনের উপলব্ধি যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে রয়েছে সেই বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে যদি বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যায় তাহলে কি বাংলাদেশ কখনো দিক হারাবে? যার মধ্যে ক্ষমতায়নের থেকে সবথেকে বড় উপলব্ধি মানুষকে ভালোবাসা- সাধারণ মানুষের সুখ দুখে সবসময় পাশে থাকার চিন্তা – তার হাত ধরেই তো সম্ভব দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। এমনটা আর কে ভাববে? তার চোখ যেন সর্বত্র! কোথায় কি হচ্ছে? দেশের কোথায় কার কি ধরনের সাহায্য সহযোগিতা দরকার? কোথায় দ্রুত মানুষের সেবা দরকার? প্রভৃতি বিষয়ে একজন মানুষ কিভাবে বর্তমান সময়ে এত খোঁজখবর রাখতে সক্ষম হয় মাঝেমধ্যে এ কথা ভাবলে অবাক লাগে। এই সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য যেন তার ওপরই নির্ভর করছে। সবশেষের খবর – “সাফজয়ী নারী দলের গোলরক্ষক রুপনা চাকমার জন্য তার নিজ শহর রাঙ্গামাটিতে একটি ঘর নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।“ এই হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা! আর উত্তরটা সেখানেই – না বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রীর সোনার বাংলাদেশ কখনো হারবে না যদি তারা সবসময় আমাদের পাশেই থাকেন।
লেখকঃ শিক্ষক, স্থপতি ও গবেষক