চিরঞ্জীব মুজিব

প্রচ্ছদ

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ:

বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে আগস্ট। এই মাসটি বাঙালির কাছে শোকের মাস হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এদিন ভোররাতে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ বিসর্জন দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁদের তিন পুত্র, দুই পুত্রবধু এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে। সেই সময়ে ইউরোপে থাকার সুবাদে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।

যে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারাটি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই বাঙ্গালি হয়ে কিভাবে ঘাতকরা জাতির পিতার বুকে গুলি চালিয়েছিল। একটি জাতির জন্মদাতাকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকের দল বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালিকে অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে শুধু নিন্দা ও ধিক্কারই এনে দেয়নি, বাঙালিকে আলো থেকে অন্ধকারের পথে নিয়ে গিয়েছিল। তবে সেটা ছিল সাময়িক। বাঙালি ঘুরে দাড়াতে পারে, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তে ফিরে আসতে পারে- তাও দেখিয়েছ। বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বেশি সময় নেয়নি। অত:পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি সংগঠিত হয়েছে এবং তাঁরই নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের দোসর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার অধ্যাদেশ জারি করে যে কলঙ্ক রচনা করেছিল, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে সেই অধ্যাদেশ বিলোপ করে বাঙালির কলঙ্ক মোচন করেন। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়। দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকা খুনিদের ফাঁসির দন্ডাদেশ এবং তা কার্যকর করা হয়।

বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্ব ভূখন্ড। এটি বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গ্রথিত এবং একটি অন্যটির পরিপূরক। বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র ফাঁসির দড়িতে ঝুলার আগে অনুধাবন করে গেছে যে, জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে শহীদ বঙ্গবন্ধু অনেক শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু জাতির কাছে অমর এবং চিরঞ্জীব।

জাতির পিতাকে হারানোর দুঃখের মধ্যে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাস জীবন কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বিনির্মাণের কাজ। জাতির পিতার দু’টি স্বপ্নের মধ্যে ছিল-বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। প্রথম স্বপ্নটি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়িত করেছিলেন। অপর স্বপ্নটি যখন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে মাঝখানে পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে ২০০৯ থেকে টানা প্রায় ১৪ বছর সরকার পরিচালনা করছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতায় উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অনেক দেশকে টপকে যাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিটির সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আজ দৃশ্যমান। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে।’ অমর্ত্য সেনের পর্যবেক্ষণমূলক এ মন্তব্য বাংলাদেশ অর্জন করেই থেমে থাকেনি; সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের রফতানি, রিজার্ভ, রেমিটেন্স এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি। সামাজিক খাতে বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারত-পাকিস্তান থেকে বেশি। মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার, জন্মহার ভারত-পাকিস্তান থেকে কম। নারীর ক্ষমতায়নেও শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়; বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় বিশ্বব্যাপী চলমান মহামারি করোনা ভাইরাসকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য করোনার নানামুখী প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও বর্তমান সরকার এ পরিস্থিতি ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছে। করোনায় দেশে মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও বিশ্বের অত্যধিক জনাধিক্যের দেশ হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলক কম। এসময় কর্মহীন হয়ে পড়া এবং নিম্মআয়ের মানুষের জন্য সরকারি খাদ্য এবং আর্থিক সহায়তার ফলে সামাজিক সুরক্ষার দিকটি মুখ থুবড়ে পড়েনি।

করোনাকালে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের পর আবার তা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনার ঢেউয়ে সারা বিশ্বে প্রতি ৩ জনে ১ জন কাজ হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকার প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অব্যাহত রাখা এবং নতুন শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা জোরদার করার পাশাপাশি বিদেশগামী শ্রমিকদের দ্রুত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী সিন্ধান্ত।

বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের আর্থিক সঙ্গতি ছিল উল্লেখ করার মতো। এই সময় বাংলাদেশ সুদান ও শ্রীলংকাকে আর্থিক ঋণ দিয়ে নিজের আর্থিক সক্ষমতার চিত্র তুলে ধরে। দুই দশক আগেও বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে প্রণয়ন করা হতো, সেখানে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশি আর্থিক সহায়তা দেয়ার আঞ্চলিক আর্থিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এ মাইলফলক অর্জিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজারেরও বেশি। যেখানে প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় দুই হাজারেরও নিচে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব সভায় বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।

বাংলাদেশের বদলে যাওয়া অর্থনীতির এ যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০১১ সাল থেকে। সেসময় বিশ্বখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রশংসা করা হয়। ২০১২ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী সাপ্তাহিক পত্রিকা দি ইকোনমিস্টও বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে বাংলাদেশের অব্যাহতভাবে অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে চিত্র উপস্থাপন করে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ব্রিটেনের আরেকটি খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান করে যে, বাংলাদেশ অর্থনীতির সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইউরোপের অর্থনীতিতে শক্তিশালী কয়েকটি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ার নব অর্থনৈতিক পরাশক্তি বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেখিয়েছে যে, ‘আমরাও পারি’। মেট্রো রেল, উড়াল সড়ক, কর্ণফুলি ট্যানেল নির্মাণের মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলো উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জানান দিচ্ছে। শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেয়া, প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণকর নানাবিধ পদক্ষেপ, আর্থিকভাবে সঙ্গতিহীন মানুষের জন্য আবাসন টাওয়ার নির্মাণ ইত্যাদি শেখ হাসিনা সরকারের বিচক্ষণ ও দূরদর্শীতা আজ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্নকে আজ দৃশ্যমান করছেন।

১৫ই আগস্ট জাতির পিতা ও সকল শহিদদের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের ষড়যন্ত্র ও সকল সহায়তাকারীদের খুঁজতে তদন্ত কমিশন এখন সময়ের দাবী। আমরা তদন্ত কমিশন চাই।

রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার অনন্য কীর্তিতে বঙ্গবন্ধু আরও চিরঞ্জীব হয়ে উঠছেন। বাঙালি আদর্শের প্রতিভূ চিরঞ্জীব শেখ মুজিবের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

লেখকঃ গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *